You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.29 | ক্ষমতা হস্তান্তর- পুনর্বিচার | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

ক্ষমতা হস্তান্তর- পুনর্বিচার (২)
অনিল চট্টোপাধ্যায়

গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভারত ১৯৩০ সালে স্বাধীনতার শপথ নিয়েছিল। ভারতীয় নেতারা তাদের একদিনকার সাহসী কমরেডদের এবং পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত শক্ত ঘাঁটিগুলাে ছেড়ে দিয়ে ভারত-ভাগে রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরে কাশ্মীর সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনাে পথ ভারত খুঁজে বের করতে পারল না। অবশ্য এর পেছনে একটা কারণও ছিল এবং সেই কারণটা হলাে, কাশ্মীরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল জাতীয় সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন। দূরদৃষ্টিশূন্য প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কোনও দল বিশেষের সংকেত বাক্যের আড়ালে কাশ্মীরকে পৃথক রাজ্যরূপে মর্যাদা দেওয়ার কথা চিন্তা করতেই পারল না যাতে করে এই রাজ্যের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা যায়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ক্ষুদ্রতার খেলা সুবিধা বুঝে দেখা দিল। যেসব মূল্যমান দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র ও সুষ্ঠু আবহাওয়া গড়ে ওঠে সেসব মূল্যমানকে কলঙ্কিত করা হলাে এবং দেশভাগােত্তর তথাকথিত দেশপ্রেমীদের সঙ্গে একদল নেতা ঐসব মূল্যমান সম্পর্কে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যাখ্যা করলেন এবং ঘৃণাপূর্ণ উক্তি করলেন। এর ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার অনধিক ২৫ বছরের মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের চিহ্ন দেখা দিল।
ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায় যে পাকিস্তানে পরিস্থিতি ঘৃণ্য ও নারকীয় হয়ে উঠেছে। অবিভক্ত ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চলগুলাের জন্যই পাকিস্তানের দাবি উঠেছিল। কারণ, সারা ভারতের তথাকথিত “বিচারবুদ্ধিহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে ঐসব অঞ্চলের অধিবাসীরা একত্রে বসবাস করতে রাজী হতে পারেনি। বস্তুত পক্ষে, আসামের কোনাে কোনাে অংশে প্রত্যক্ষভাবে মুসলিম নির্বাচক মণ্ডলীর এবং ভারতের অন্যান্য অংশে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ কর্তৃক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়ােগের ফলেই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার অব্যবহিত পরে পশ্চিম পাকিস্তানের একদল-মুষ্টিমেয় ব্যক্তি সব ক্ষমতার একচেটিয়া অধিকার লাভ করল। স্বাভাবিক গণতন্ত্রসম্মত জন প্রতিনিধিত্ব অনুযায়ী সংগঠিত প্রাথমিক, পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেভাবে প্রতিভাত হয়েছিল, তা পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ মুষ্টিমেয় শাসকগােষ্ঠী বরদাস্ত করতে পারল না।
ঐ মুষ্টিমেয় শাসকগােষ্ঠী এমন এক অভিনব পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন, যার ফলে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সমতায় পরিণত হলাে। তারপর, জন্মলাভের ১২ বছরের মধ্যে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের খােলা পথ বন্ধ করে দিয়ে সামরিক একনায়কতন্ত্র স্থাপন করা হলাে। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের সংস্কৃতিগত ও জাতিগত আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এখন সেই পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন শাসকদের শােষণের ক্ষেত্র এক উপনিবেশে রূপান্তরিত হলাে। ভারত যখন ব্রিটিশের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, তখন ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থরক্ষার জন্য যে সামরিক বিভাগ স্থাপিত ও শিক্ষিত হয়েছিল, সেই সামরিক চক্রই পাকিস্তানের বর্তমান শাসকগােষ্ঠী।
ব্রিটিশ প্রভুদের প্রতি বিশ্বস্ততার জন্য ঐ সামরিক চক্র সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। আর ব্রিটিশ রাজশক্তি যতদিন এদেশে ছিল, সে সময় কোনাে দিনই দেশ বা দশের জন্য ঐ সামরিক চক্র বিবেকের দংশন’ অনুভব করেনি। স্বজনদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের মাঝেই তারা পরিবর্ধিত হয়েছে। তাদের মালিক চলে যাওয়ার পরে এখন তারা ক্ষমতা অধিকার করেছে। এবং, সুদীর্ঘ প্রায় এক হাজার বছর বাদে তারা আবার দ্বিতীয় “দাস বংশ” স্থাপন করেছে। তবে এবার তারা পাকিস্তানের জনগণের ওপরই তাদের প্রভূত্ব কায়েম করেছে।
কিন্তু জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে জোর করে পাকিস্তানের জনগণকে যে হীন মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সেখানকার জনগণ আর খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। জাতিগত ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন পূর্বপাকিস্তানিরা ধর্ম ছাড়া আর কোনাে বিপদে পশ্চিমী ভাইদের সঙ্গে নিজেদের মিল খুঁজে পায় না। প্রগতি, সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ইসলাম ধর্মীয় সৌভ্রাত্র ও সংহতির পতাকাতলে একদিন তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা লাভ করেছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাধিকারের ফলে তাদের সেই প্রেরণা ও আশা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্ট হওয়ার পরে কিছুকালের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৫০ সালে নির্বাচনে যেদিন মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে পর্যদস্ত হয়, সেদিন এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝা গিয়েছিল যে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্পর্কে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের মানুষদের মােহমুক্তি ঘটেছে। তারপর থেকে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক শােষণ ও রাজনৈতিক বৈষম্য প্রভৃতি নানা কারণে জনগণের বিক্ষোভ উত্তাল হয়ে উঠেছে। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকারের দাবীতে আওয়ামী লীগ এই অঞ্চলের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। সাম্প্রতিককালে নির্বাচনে এই দলের অভূতপূর্ব বিজয় কিছুকালের জন্য জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। আশাবাদী ব্যক্তিরা আশা করেছিলেন যে বােধ হয় পূর্বাঞ্চলকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযােগ দেওয়া হবে। কিন্তু, সব সময় অত্যাচারীরা একই পথ গ্রহণ করে থাকে তারা বাধ্য না হলে সহজে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চায় না। গণতান্ত্রিক পন্থায় গণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সারাদেশ জুড়ে আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ শােভাযাত্রা এবং অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আওয়ামী লীগ পূর্ববাংলার যে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছে, তা থেকে ভারতকে নতুন করে পাঠ নিতে হবে।
ভারতীয়দের আত্ম প্রবঞ্চনাকে অভ্যাস করার ক্ষমতা অসীম। সেজন্য দীর্ঘকাল ধরে তারা আইন অমান্য ও অসহযােগ আন্দোলনের রহস্যময় ক্ষমতার ওপরই জোর দিয়ে বলে এসেছে যে ঐ রহস্যময় ক্ষমতার বলেই নাকি তারা সব চাইতে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফলকাম হয়েছে। উত্তরসূরীদের যােগ্যতা প্রমাণের জন্যই ব্রিটিশ কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রকৃত কারণগুলাে বিশ্লেষণ না করে এ ধরনের নিশ্চিত উক্তির অবতারণা করতে হয়েছে। ঐ গালভরা তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্যই পাকিস্তানের এই অত্যাচারী শাসকগােষ্ঠী রাজনৈতিক মীমাংসা সম্পর্কে আলােচনা চলাকালীন অবস্থায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল এবং আপন দেশের লক্ষ লক্ষ নাগরিককে নিধনের জন্য পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে মানব ইতিহাসে ঘৃণ্যতম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
এই বীভৎস বিশ্বাসঘাতকতা থেকেই নতুন বাংলার আবির্ভাব ঘটেছে। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম জনসাধারণ অন্যায়কে প্রতিরােধ করে আপন অধিকার রক্ষার জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহে উদ্যোগী হলাে। মানবতা এবং সভ্যতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ অনুষ্ঠিত হলাে, তা দেখে দুটি শত্রুভাবাপন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্ন বাঙালি জাতি আতঙ্কে থমকে দাঁড়াল। সাধারণ মানুষের এই রক্তপাতে তাদের অন্তর পরিশুদ্ধ হলাে আর তারা সম্পূর্ণরূপে পারস্পরিক অপরাধবােধ থেকে মুক্ত হলাে। পূর্ব পাকিস্তান বাঙালি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে।
ঐতিহাসিক প্রয়ােজনেই পূর্বপাকিস্তান বাংলার জনগণের এই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের ভার নিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চর এই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ মিলন-সংকেতের সময়ােচিত আয়ােজন করেছে। আর সেজন্য যে সুদীর্ঘকালীন সগ্রাম হবে তাতে অনেক রক্ত ঝরাতে হবে, অনেক অশ্রু বিসর্জন করতে হবে আমাদের পুনরুত্থানের জন্য। সেই বিতিক্ত সংগ্রামে পশ্চিম বাংলা পূর্ব বাংলার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে বরং, বলা যায় যে পশ্চিম বাংলা পূর্ব বাংলার সঙ্গে যেন মিলে গেছে।

সূত্র: কম্পাস, ২৯শে মে ১৯৭১