You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা
সুদিন ভট্টাচার্য

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ইয়াহিয়া খাঁ বােধ হয় যা চেয়েছিলেন তাই হতে চলেছে। পূর্ব বাংলার প্রায় এক কোটি হিন্দু এবং কয়েক লক্ষ শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মুসলমান সে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পথে। এর ফলে সুচতুর রাজনীতিবিদ ভূট্টোর আশা পূর্ণ হবে বাঙালিরা পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হবে। তার প্রতিক্রিয়া হবে সুদূর প্রসারী। পূর্ব বাংলায় গণবিপ্লবের সময় পাকিস্তান সরকার যেমন মাসাধিককাল ধরে গড়ে দৈনিক ১ কোটি টাকা সামরিক ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছেন এবং প্রায় ৭০ কোটি টাকার মতাে বৈদেশিক মুদ্রা রােজগার করতে অক্ষম হয়েছে তেমনি ভারতকেও প্রতিদিন আশ্রয়প্রার্থীদের ভরণপােষণের জন্য একই প্রকার অর্থ ব্যয় করতে হবে তা ছাড়া সামাজিক এবং রাজনৈতিক কুফলতাে আছেই।
কিন্তু কেন এমন হতে চলেছে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ব্যর্থতা? পাকিস্তানি সৈন্যদের অসাধারণ উন্নতমানের অস্ত্রাদি এবং দক্ষতা? না ভারতের ব্যর্থতা? এই তিনটি বিষয় একে একে আললাচনা করা যাক।
(১) আওয়ামী লীগ খুব বেশিদিনের দল নয়। নেতৃত্বও তরুণ। এর সুবিধা এবং অসুবিধা দুইই আছে। অহিংস সগ্রামে অভ্যস্ত নেতৃত্ব হিংস সগ্রামের প্রস্তুতি চালাতে স্বভাবতই অক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত: এঁদের সমর্থকদের একাংশ, ছাত্ররা আদর্শনিষ্ঠ এবং সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে থাকলেও দূর গ্রামাঞ্চলে তাদের প্রভাব ততটা কার্যকর হয়নি। সেখানে এখনও লীগযুগের ধর্মান্ধতার রেশ কমবেশি রয়ে গিয়েছে। ইয়াহিয়া চক্র এই সুযােগ কাজে লাগিয়েছেন। তৃতীয়ত শেখ মুজিবরের ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্ব ছিল এই দলের সবচেয়ে বড় ভরসা। ২৫শে মার্চ রাত্রে মুজিবর রহমান পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ায় তাঁর দল অনেক পরিমাণে দিশাহারা হয়ে পড়ে। সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে লীগের নেতৃবৃন্দের বিন্দুমাত্র ধারণা থাকলে তারা বিদ্রোহ করার জন্য ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন না এবং সৈন্যদের হাতে পুলিশ ও ই. পি. আরকে নিরস্ত্র এবং প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে দিতেন না এবং প্রথম দিনেই তারা ঢাকা বিমানঘাঁটি দখল করবার চেষ্টা করতেন।
(২) পাকিস্তান মােটামুটি শক্তিশালী দেশ। Time পত্রিকার তথ্য যদি ঠিক হয় তবে বুঝতে হবে, যে দেশের ঐ সৈন্যদলে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে মাত্র একজন পূর্ববাংলার মানুষ। মাত্র ৫/৬ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য পূর্ব বাংলার তার মধ্যেও বহু অবাঙালি সৈন্য ও অফিসার ছিল। এর মধ্যেও অর্ধেক ছিল পশ্চিম অংশে।
সুতরাং বিদ্রোহের দিনে মাত্র হাজারখানিক সামরিক শিক্ষিত বাঙালি পূর্ববাংলায় উপস্থিত ছিলেন, ই. পি. আর প্রকৃতপক্ষে সীমান্ত পুলিশ। এদের অল্প সংখ্যক স্টেন, L, M. G.২ ও ৩মর্টার ছিল। কিন্তু সামরিক শিক্ষার মানের দিক দিয়ে এরা খুবই পশ্চাৎপদ। আনসারদের অস্ত্রশস্ত্র খুব কমই ছিল, সামরিক শিক্ষার মানও ছিল শশাচনীয়। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য ও স্বদেশ প্রেমের দ্বারা তাে যুদ্ধ করা যায় না —বিশেষত পূর্ব বাংলার খােলামাঠে এবং গ্রীষ্মকালের ফসলহীন ক্ষেতের উপর যুদ্ধ হলে জিতবার কোননা আশাই থাকে না আধুনিক সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে।
পাকিস্তানের সামরিক শক্তি Statesman- এর হিরন্ময় কার্লেকার মহাশয় যা দিয়েছেন ততটা নয়। Institute of Strategic Studies এর মতে তার চেয়ে অনেক কম। নিয়মিত সৈন্য প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার, কাশ্মীরের আধাসৈন্য প্রায় ৩০ হাজার। এছাড়া আছে স্কাউট, রেঞ্জার ইত্যাদি অনিয়মিত কিন্তু মােটামুটি দক্ষ সৈন্য আরও ৪০/৫০ হাজারের মতাে। অস্ত্র শস্ত্রে ঐ ২৭০০০০ সৈন্য বেশ আধুনিক, বাকীরা সেকেলে। মার্কিন বদান্যতায় পাওয়া এবং ১৯৬৫’র ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া ৪০০ মাঝারি ট্যাঙ্ক এবং রাশিয়া ও চীন থেকে পাওয়া ৩০০ এর মতাে মাঝারি ট্যাঙ্ক আছে। হাল্কা ট্যাঙ্ক (মার্কিন ও চীনা) এবং উভচর ট্যাঙ্ক (রাশিয়ান PT-76) মিলে আরও ২০০ এর মতাে হতে পারে। কামান বেশির ভাগই পুরানাে ২৫-পাউণ্ডার হলেও অল্প সংখ্যক মার্কিন ও রুশ খুব ভারী কামান ও ভালাে জাতের চীনা মর্টার ও রকেটও আছে। পূর্ববাংলায় কিন্তু এই বাহিনীর সাত ভাগের একভাগও ছিল না ২৫শে মার্চ। এবং তার পরের একমাসে বিদেশীদের মতে আরও ১০/১২ হাজার সৈন্য আমদানি করা হয় জাহাজ ও বিমান পথে। আর ছিল ২০/২২ খানার মতাে পুরাতন স্যাবার জেট বিমান। অল্প সংখ্যক হেলিকপ্টার, গানশিপ’ও ছিল পূর্ববাংলায়।
আওয়ামী লীগের Rag-tag Circus এর তুলনায় এই ৩০/৪০ হাজার নিয়মিত সৈন্য এবং তাছাড়া ৪০ শতাংশ লেজুড় যথেষ্ট শক্তিশালী একথা বলাই বাহুল্য। ই,পি, আর এর কোনাে রণসম্ভারই এই বাহিনীর বা স্যাবার জেটগুলাের মােকাবিলা করবার পক্ষে উপযুক্ত নয়। সুতরাং ফল যা হওয়ার হয়েছে।
(৩) ভারতের শােচনীয় ব্যর্থতার ইতিহাস বড়ই করুণ। এমন সুবর্ণ সুযোেগ যে দেশ গ্রহণ করতে না পারে সে দেশের নেতৃত্ব ক্ষমার অযােগ্য। পাকিস্তান ভারতের শত্রুদেশ। ১৯৬৫ সালের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, কোনাে প্রকার কূটনৈতিক সৌজন্য প্রদর্শনও হয় না। পাকিস্তানের একমাত্র কাম্য হলাে ভারতের সর্বনাশ হােক। যেন-তেন প্রকারে ভারত সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল হােক। নাগা মিজো তামিলরা বলুক যে আমরা ভারতের মধ্যে থাকবে না। চীন ও ভারত এশিয়ার এই দুটি প্রধানশক্তি পরস্পর শত্রুতার মধ্যে কালযাপন করুক-পাকিস্তান এই চায়। তার বিনিময়ে ভারত ক্রমাগত চাইছে যে পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করুক। দ্র আচরণ করুক ইত্যাদি। এর চেয়ে হাস্যকর মূখতা আর কি হতে পারে! জার্মানির মদগবী প্রাশিয়ান জাঙ্কারদের মতাে শৌর্যবীর্যগর্বী পাঞ্জাবী আফ্রিদি বেলুচরাও ভাবে যে ভারত আমাদের কি ক্ষতি করবে? আমাদের সহায় চীন, তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব এবং লিবিয়া এই শেষােক্ত দেশ দুটির তেল বিক্রির টাকার একটা বড় অংশ যেমন ইসরেলীদের বিরােধী আরবরা পাচ্ছে তেমন এর একটা উল্লেখযােগ্য অংশ পাচ্ছে হিন্দু বিরােধীর ভূমিকায় পাকিস্তান। সামরিক শক্তির দিক থেকে একমাত্র চীন শক্তিমান। তুরস্ক ও ইরানের কিছু আধুনিক রণসম্ভার আছে কিন্তু সাহায্য দেওয়ার মতাে কিছু না। Statesman (12th May) এ কুলদীপ নায়ার লিখেছেন যে ইরান ও তুরস্ক পাকিস্তানকে F-5 এবং F-82 বিমান দিয়েছে। অত কথা। ঐ F-5 মার্কিনরা ১৯৬২ সালে ভারতকে দিতে চেয়েছিল। ভারত নিতে রাজী হয়নি। মান্ধাতার আমলের F-82 (না ছাপার ভুল F-86?) কি করবে? ভারতে প্রায় ৩-৪ শত Mig-21 ও S-22 যাদের গতিবেগ উপরােক্ত বিমানদ্বয়ের গতিবেগের দ্বিগুণ তাদের সামনে ২০/২৫ খান ঐ বিমান কি করবে? ইরানে খানকয়েক Phantom (F-4 F) আছে কিন্তু ঐ কখানাই বা কি হবে? কিন্তু ভবিষ্যতে ভারতের এই বর্তমান সুবিধা নাও থাকতে পারে। সুতরাং এমন সুবর্ণ সুযোেগ ভারতের হারানাে উচিত নয়। এবং শেষ পর্যন্ত কুলদীপ নায়ারও অবশ্য বলেছেন-“India can still issue an ultimatum to Pakistan to stop the influx of refugees or face the consequences.”

নিচে এশিয়ার কয়েকটি দেশের সৈন্য ও বিমানের সংখ্যা দেওয়া হলাে—
চীন (১) নিয়মিত সৈন্য ২৫ লক্ষ, ৬টি আর্মার্ড ডিভিসন, ৪০০০ ট্যাঙ্ক (২) ২৫০০ যুদ্ধবিমান অধিকাংশ মিগ-১৭ ও ১৯, সামান্য সংখ্যক ২০ এবং ৩০০ ইলিউসিন-২৮ (ক্যানবেরার চেয়ে মন্থরগতি এবং কম উচ্চে উড়তে পারে।)
ভারত-(১) নিয়মিত সৈন্য ১০ লক্ষ, ৩ আর্মার্ড ডিভিসন বা সমসংখ্যক ব্রিগেড ও রেজিমেন্ট, ১০০০ মাঝারী ও ৪০০ হাল্কা ট্যাঙ্ক (২) প্রায় ১০০০ যুদ্ধবিমান এক তৃতীয়াংশ শব্দের দ্বিগুণ গতিবেগ সম্পন্ন, ৭০ বােমারু। ৪০০০ কামান।
পাকিস্তান- (১) নিয়মিত সৈন্য প্রায় ৩ লক্ষ, ২ আর্মার্ড ডিভিসন, ৭০০ মাঝারি, ১০০ হাল্কা ট্যাঙ্ক (২) প্রায় ৩০০ যুদ্ধ বিমান মাত্র ৩০টি শব্দের দ্বিগুণ গতিবেগ সম্পন্ন (মিরাজ)। ১০০০ কামান।
তুরস্কের শক্তি পাকিস্তানের চেয়ে একটু বেশি এবং ইরানের শক্তি বহু গুণ কম। সৌদি আরবের ২৫ খানা শব্দের দ্বিগুণ অধিক গতিবেগ সম্পন্ন লাইটনিং বিমান আছে।
যেহেতু চীন সম্ভাবিত কোনাে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বার কোনাে সম্ভাবনাই নেই বলা চলে, কারণ তাকে রাশিয়া ও আমেরিকার মােকাবিলা করতে হয় এবং ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করা তার নীতিও নয়; তখন পাকিস্থান কোন সাহসে ভারতের সঙ্গে লড়তে চায়? পাঞ্জাবী মিলিটারি আভিজাত্যের দর্প চূর্ণ করার এবং তথাকথিত আজাদ কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করবার, চিরকালের মতাে নাগা-মিজো সমস্যার সমাধান করবার মতাে এমন সুযােগ আর কখনও আসবে না। কারণ এখন পাকিস্তানের মাত্র ৮ ডিভিশন সৈন্য পশ্চিমে আর চার ডিভিসন পূর্ব দিকে। সুবর্ণ সুযােগ।
আর ভারত আজ যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় বস্তৃত ভয় পেয়ে অকারণে ভারত পিছিয়েই গেছে তবে ইতিহাস তার জন্য ক্ষমা করবে না। প্রায় এককোটি নবাগতের ভরণ-পােষণের ব্যবস্থা করতে তাকে দেউলিয়া হতে হবে এবং কেউ তাকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে আসবে না। কারণ মার্কিনরা জানে, রুশরাও জানে ভারতকে এখন সাহায্য করার অর্থ হলাে এশিয়াতে আর একটি “চীনের সৃষ্টি করা। তার চেয়ে সামরিক ভারসাম্যের নিষ্ফল ধোকাবাজী চলতে থাকুক। মরুক ভারত আশ্রয়প্রার্থী সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে।
বলতে বাধা নেই যে সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাধিক্যে জয়লাভ করায় ইন্দিরাজীর প্রতি অনেক বিরূপ জনেরও একটু শ্ৰদ্ধার ভাব উদয় হচ্ছিল। পূর্ব বাংলার প্রতি আচরণের অপ্রতুলতায়, ব্যর্থতায় আজ তারা সকলেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন একথা বলাই বাহুল্য। এর ফলে ভারতের রাজনীতির এই কষ্টার্জিত স্থিতিশীলতা আর বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। কার্যকালে যার বল কার্যকর নয়’ এমন মানুষ কখনও কারাে শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ভারতের চরম ব্যর্থতা সত্যই বেদনাদায়ক। পাকিস্তানি জঙ্গীবাদের জয় হলে এশিয়া ভূখণ্ডে গুরুতর বিপর্যয় ঘটতে পারে। এবং তার জন্য ভারতের দায়িত্ব হবে পাকিস্তানের চেয়ে কম নয়।

সূত্র: কম্পাস, ২৯শে মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!