You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.18 | শহিদের রক্তে লাল বাংলার মাটি | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

বর্মার পত্র

শহিদের রক্তে লাল বাংলার মাটি
সারা বর্মাদেশের জনগণ আজ স্তম্ভিত হয়েছেন, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর হৃদয়,-নর-পশুদের অমানুষিক অত্যাচার দেখে।
বাংলাদেশে পশ্চিমী অসুর জাতির হিংস্র শাসনে- সৈনিকের বুলেট বর্ষণে শহিদদের রক্তে লাল হলাে “বাংলাদেশ।”
চোখের জলধারায় বিলাপের খদোক্তিতে শােক প্রকাশ করে সকলেই বলেছেন দীর্ঘদিন ব্রিটিশ শাসনেও বহুরকম রক্ত বিপ্লবেও মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করে এত বেশি ছাত্রছাত্রীকে একসাথে হত্যা করা হয়নি। আজ পূর্ব বাংলায় যা সম্ভব হলাে, তা জগতে মানবজাতির অপমান।
বাংলার মাটিতে এই শহিদদের রক্তদান কখনও নিষ্ফল হবে না, বর্মায় আজ সকলে এই কথা বলছেন। বিপ্লবের রক্তে লাল হয়ে জগতে বাঙালি জাতির জ্বলন্ত ইতিহাস চিরকাল অম্লান থাকবে।
মেশিনগানের গুলিতে শত শত বাঙালি শহিদ হলাে। আরও লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে মরতে হবে, তবুও পশ্চিমা নরপিশাচদের বাঙালিরা বাংলাদেশের মাথার উপর বসে বাংলার ধনসম্পদ লুটে খাওয়ার সুযোেগ দেবে না। এই প্রতিজ্ঞাই আজ জাতির মেরুদণ্ড রক্ষার শামিল বলেই বহুজনে বলছেন।
আজ সকলের মাথায় ভালােভাবে ঢুকেছে, পাকিস্তান নামটি সম্পূর্ণ বেঈমানিতে গড়া। এই নামের ভিতরে রয়েছে অমানুষিক শশাষণনীতি ও অত্যাচার, আর তা যে কতই মর্মঘাতী, আজ সকলেই বুঝেছেন।
বাংলাদেশ হতে পাকিস্তান নামটিও দূর করতে হবে এই উক্তি অনেকের মুখে শােনা যাচ্ছে। সকলে বলছেন পাকিস্তান নামের আবরণে বেঈমানিস্তানের নরঘাতক রাক্ষসরাজত্ব ছাড়া আর ঈমানদারির কিছুই
নেই।
তাই নজরুলের মুখের ভাষায় বলতে হলাে ,
খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি
অর্জুন ছেড়ে বান, জেগেছে বাংলা ধরিয়া লাঠি
হিন্দু-মুসলমান।
১৮ এপ্রিল ১৯৭১

বর্মার পত্র

জগতের বড় বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া
জগতের বড় বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া গণতান্ত্রিক নীতি চূর্ণ করে বাংলার বুকে রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির সৃষ্টি করলাে। এবং এই পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ দায়ী বাংলার রক্তশােষক পাঞ্জাবী ডাকাত দলের সর্দার ইয়াহিয়া আর সিন্ধীজাত দস্যু ভূট্টো। এই কথা বর্মায় সকলের মুখে শােনা যাচ্ছে।
বর্মায় বিপ্লবী উপদ্রব শান্ত করার জন্য বহুবার বিপ্লবীদলকে রেঙ্গুনে ডেকে এনে পরামর্শ করা সত্ত্বেও তা সফল হয়নি। তবুও রাষ্ট্রপতি কারাে প্রতি একটুও অন্যায় ব্যবহার করেননি। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ ও আলােচনার সময় ভাই ভাই অভেদ পরিবেশ দেখিয়েছেন জেনারেল নেউইন। তাই অনেকেই বলছেন ইসলামিক রাষ্ট্রনামে খ্যাত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির দুষ্ট চরিত্রই প্রমাণ হলাে আজ জগতে। ইয়াহিয়ার কাছে মনুষ্যতের গুণধর্মের কিছুই দেখা যায়নি।
অনেকে আজ বলছেন, মুজিবদলের আশা ভরসার স্থান ভারত কি পূর্ণসাহসে তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে? সকলের মনােবল অটুট থাকলে বাংলার বিপ্লবীদের জয় অবশ্যম্ভাবী। যুদ্ধ চলুক, ভিয়েতনাম আদর্শ হউক বিপ্লবীদের। অত্যাচারীর বেঈমানির কেল্লা একদিন চূর্ণ বিচূর্ণ হবেই।

নিউজ জার্নালের প্রবন্ধ
রেঙ্গুনের প্রখ্যাত সাপ্তাহিক “বাংলাদেশ” শিরােনামায় লিখেছেন: ১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ বৃহস্পতিবার রাত্র হতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অমানুষিক অত্যাচারের ভিতর দিয়ে জগতের বুকে “বাংলাদেশ” নামে আরেকটি নতুন রাজ্য সৃষ্টি হলাে। একটি বিরাট জাতির এই নাম কেউই উপেক্ষা করতে পারবে না। সত্বর বা বিলম্বে সকলকেই একদিন এই দেশকে স্বীকার করতে হবে।

শয়তানের কুকীর্তি
মুজিবের সাথে পরামর্শের ছলনায় জল আর আগুনের নাটকীয় তামাসা দেখিয়েছেন পাকিস্তান রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া! মুখে সরলতা দেখিয়ে ভিতরে ভিতরে সকলকে মেরে ফেলার চেষ্টা_পূর্বপরিকল্পিত নীতিরই প্রকাশ। ২৫ তারিখ রাত হতে হঠাৎ ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু করে পাকিস্তানি সৈনিকেরা। ঢাকা কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্ররা সকলেই যখন রাত্রে অঘাের দ্রিাভিভূত ছিলেন তখন হঠাৎ ইয়াহিয়ার রকেট, ও ট্যাঙ্কের গুলিতে সকলকে হত্যা করা হয়। দেশের আজাদীর জন্য দ্রিাবেশে শহীদ হলেন কলেজের ছাত্র ও অধ্যাপকেরা। ঢাকা চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরে হাজার হাজার নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে।

মুক্তি কামনা
পূর্ববঙ্গের জনগণ নিজপ্রাণ দিয়ে হলেও কেন যে দেশের আজাদী চাইছে, আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা কেন যে অমানুষিক অত্যাচার করে পূর্ববাংলা হাতের মুষ্টিবদ্ধ করেও রাখতে চায়, এর কারণ ১৯৪৭ সন হতেপাকিস্তানের জন্ম হতে আজ অবধি রাজনীতি আর সৈনিকশক্তিতে পশ্চিমীরা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে বাংলাদেশকে। হুকুমতকে খােদার দেওয়া দিনের মতাে বন্দুকের কুদরতে তাদের হাতেই আছে অসুরের শক্তি। পাকিস্তানের সৈনিককর্তারা ৯০% পশ্চিমী। অর্থনীতিতে কী রকম রেখেছে তা বিশেষভাবে বলবার প্রয়ােজন নেই।

রাক্ষসের রাজত্ব
“পূর্ববঙ্গের রক্তশােষণের প্রমাণ স্বরূপ দেখা যায় বিদেশীমুদ্রা উপার্জনে শুধু পাট হতেই অর্ধেকের বেশি লাভ হয়। কিন্তু প্রত্যেকবার ব্যয়ের হিসাবে মাত্র ৩০% বাংলাদেশে খরচ করা হয়। তাও না দেবার ইচ্ছায় দিতে হয়। অন্যদেশ হতে যে বিদেশী সাহায্য আসে তার মাত্র ২০% বাংলাদেশ পায়। পশ্চিম পাকিস্তানি নতুন শহর তৈয়ার করাতে জলের মতাে অর্থব্যয় করা হয়েছে। পূর্ব বঙ্গের রাস্তাঘাট, ঘরদুয়ার, ইত্যাদি আবাদীতে কিছুই দেওয়া হয়নি।

অমানুষিক শক্রতা
১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধের সময় হতে দুইদেশের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন নেওয়া দেওয়া, জিনিস পত্রের বেচাকেনার পথ বন্ধুর হয়েছে। এইজন্য অন্য দূরদেশ হতে আমদানি করা পণ্যদ্রব্যাদির জন্য পূর্ববাংলাকে পাঁচগুণ বেশি দাম দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। পাশের দেশে শক্রতার জন্য পূর্ববাংলার ব্যবসায়ীরা ক্ষগ্রিস্ত হচ্ছে। সস্তায় ভারতের কয়লা ক্রয় না করে পাঁচগুণ বেশি দিয়ে চীন আর পােল্যান্ড হতে কয়লা আনা হয়। ফলে পূর্ববঙ্গে আয়ের থেকে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। বাংলাদেশের উন্নতিতে ব্যাঘাত হয়। এজন্যই পূর্ববঙ্গবাসীরা পশ্চিমপাকিস্তানিদের কবল হতে নিষ্কৃতি চাইছেন।”

গ্রেট বেঙ্গল
“বর্মার খ্যাতনামা রাজনীতিজ্ঞ উচনিন “সুইট” পত্রিকায় দীর্ঘ প্রবন্ধে লিখেছেন: বাঙালি জাতির ইতিহাস বড় কঠিন বড়ই অটল। এই জাতি একবার খেপলে আর দমন করা সম্ভব নয়।
“বিগত পঁচিশ বৎসর অবধি পাঞ্জাবি-পাঠান শাসন নীতির বহুরকম নিদারুণ অত্যাচার তিক্ত করে তুলেছে পূর্ববঙ্গবাসীকে। পচিশ বৎসর দারুণ তিক্ততা হজম করে আর সহ্য করা সম্ভব হয়নি তাদের। তাই। তারা আজ বাংলার স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধে নেমেছেন।
“জগতের রাজনীতির ইতিহাসে কোনকালেই দেখা যায়নি, গােলাগুলির দ্বারা কোনাে দেশকে দীর্ঘদিন দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। নিজেদের স্বায়ত্বশাসন বাঙালি জাতির জন্মগত অধিকার। এতােবড় বিরাট জাতির পক্ষে আজ আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে জগতে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

নরঘাতকের কবলে বাঙালি সাহিত্যিক ও সম্পাদক
“নরঘাতক বর্বর ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবী সৈন্যদল ঢাকাতে বহু নিরপরাধ বাঙালি সাহিত্যিক ও সম্পাদক-গণকে হত্যা করেছে। নরপশুদের অত্যাচারের এই নিদারুণ খবর বর্মায় আসতে সকলে বিস্মিত হয়ে বলছেন ভিয়েত্রম ও আরব যুদ্ধেও মানুষের দ্বারা সম্ভব এই রকম অত্যাচারের নজির নেই। জগতের কোথাও কোনােদিন এই রকম পশুবৎ হৃদয়হীন আচরণ দেখা যায়নি। আজ পূর্ববঙ্গে বর্বর পশ্চিম পাঞ্জাবি জাতির অত্যাচার জগতে মানবজাতির কলঙ্ক। ভিয়েম ও আরব যুদ্ধেও এতাে বড় ব্যাপক ব্যাভিচার দেখা যায়নি কোনােদিন।

সূত্র: কম্পাস, ১৮ এপ্রিল ১৯৭১