You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.19 | বাংলাদেশ : ভারতবর্ষ : আন্তর্জাতিক বণিকী রাজনীতি | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ : ভারতবর্ষ : আন্তর্জাতিক বণিকী রাজনীতি
রমানাথ ঘােষ

বাংলাদেশের বুকের উপর পাকিস্তানের আসুরিক তাণ্ডব নৃত্য দুইমাস হতে চলল চলছে। শিকারি যেমন জঙ্গলে নির্বিবাদে জন্তু জানােয়ার নিধন করে, ঠিক তেমনিভাবে পাকিস্তানি সেনা মানুষ বধ করে চলছে। আগ্নেয় অস্ত্ৰদ্বারা কিশাের ও যুবকগণকে হত্যা করা হচ্ছে, হত্যা হচ্ছে নারীদের, বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ শকুনি গৃধিনীদের আহার। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে এই নারকীয় লীলা সংঘটিত হয়ে চলেছে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাস গড়িয়ে অন্যমাসে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে যে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল চার্চিল, মাউন্টব্যাটেনের ছত্রচ্ছায়ায় তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের অনুমােদনে, আজ তা বালির বাঁধের মতাে ভাঙনের মুখে। পাকিস্তানি জঙ্গীনায়কদের সামনে রেখে আন্তর্জাতিক বণিকী রাজনীতি তাদের দাবাখেলার চাল ঠিক ঠিক ভাবে দিয়ে চলেছে। শিকার হচ্ছে লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীতে নানাস্থানে নানাভাবে বহু রাজনৈতিক অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিল দুইটি বা কয়েকটি বৃহৎ শক্তি। ভিয়েতনাম ছাড়া প্রায় প্রতিটি বিপ্লবই হয়েছে তাঁবেদারী বিপ্লব। বাংলাদেশের বিপ্লব কিন্তু তাবেদারী বিপ্লব নয়।
বাংলাদেশের বিপ্লব এক নতুন আলাের দিশারী। এই আলাের বন্যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত বিপ্লব দর্শন রচিত হয়েছে তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। যুগ ও কালের পরিমণ্ডলে সব কিছুই মার্জিত হয়, তেমনি বিপ্লবের তত্ত্ব, আদর্শ এবং সর্বোপরি নীতিও সংস্কার মণ্ডিত হয়। বাংলাদেশের বিপ্লব তেমনি একটা নতুন ভাবনা। ঠিক একশত বছর আগে মার্ক্সস এমন একটি নতুন ভাবনা তত্ত্ব ও তথ্য মাধ্যমে উপস্থিত করেছিলেন। তারপর সেই তত্ত্বও তথ্যেরও সংস্কার হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশের বৈপ্লবিক আগ্নেয়গিরি মাল মশলায় আমরা হয়তাে খুব বেশি তত্ত্ব ও তথ্যের সন্ধান আপাতত পাচ্ছি না কিন্তু পাচ্ছি একটি নতুন। চেতনা ও গতি। ভবিষ্যতে এই চেতনা ও গতি থেকেই আমরা নানা তত্ত্ব ও তথ্য পাবাে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিপ্লব তাত্ত্বিক নয় -চৈতন্যময়।
হৃদয় ও প্রাণের তরঙ্গে তরঙ্গে যে চেতনা কোনাে কিছু বিচার না করে এক দুর্বার গতিশীল সত্ত্বার জন্ম। দেয়; যে সত্ত্বা আগামীকালের মানবতার, সভ্যতার সততার নিরিখ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের সাতকোটি মানুষ সেই স্পন্দনে স্পন্দিত। মুজিবর সেই স্রোতে ভাসমান জলযানের মাঝি। মুজিবরকে সৃষ্টি করেছে এই চেতন-সমুদ্র। তার ঢেউ উত্তাল ও ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর।
ভারতবর্ষ এই চেতন সমুদ্রের তরঙ্গে দোলায়মান। কয়েক বৎসর আগে ভারতবর্ষে এবং বাংলাদেশেও তথাকথিত ধর্মের জিগিরে রাজনীতির মূল্যায়ন হতাে। বাংলাদেশে আজ তা হচ্ছে না। এটা কোনাে যাদুবিদ্যা নয়, ইতিহাসের এবং মানবতার এক আত্মিক শক্তির নবজাগরণ। বাংলাদেশ এক নবচেতনার পরশমণিতে সােনা হতে চলছে। এইবার আমাদের পালা। শুধুমাত্র কয়েক লক্ষ আশ্রয় প্রার্থীকে খাদ্য বস্তু ইত্যাদি দিয়ে আমরা পার পাবাে না। আমাদেরও শুদ্ধ হয়ে উঠতে হবে। তার জন্য কত মূল্য দিতে হবে হিসাবের মাপকাঠিতে তার মাপ হবে না। আমাদের নেতৃবৃন্দ এই তরঙ্গকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চেষ্টা করলেও পারবেন না। বন্যার স্রোতের মতাে সেই সমুদ্রতরঙ্গ ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে সমস্ত ভারতবর্ষকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেই।
পৃথিবীর সমস্ত বড় রাষ্ট্রগুলাে তা বুঝতে পেরেছে। সেই জন্যই তারা মুখ বন্ধ করে বসে আছে এবং কোনাে কোনাে রাষ্ট্র খােলাখুলিই বর্বর পাকিস্তান শক্তিকে তলে তলে প্রচুর সাহায্য করে চলেছে এবং ভারতবর্ষকে টন টন গুঁড়া দুধ ও ভিটামিন ট্যাবলেট দয়ার দান হিসাবে দিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আগত মৃতপ্রায় শরণার্থীদের জন্য। এ যেন মৃতপ্রায় মানুষের মুখে দু ফোঁটা গঙ্গাজল দেওয়া।
এখন পৃথিবীর প্রায় দেশগুলােই বড় বড় আদর্শ ও তত্ত্বের আড়ালে তলজুয়ারী বণিকীনীতি চালায়। বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতি বণিকীনীতির মানদণ্ডে ঝকমক করছে। জমি দখল করবার জন্য যুদ্ধ আজ আর হয় না। বড় বড় রাষ্ট্রের প্রচুর উৎপাদন। সকলেই বাজার চায়। অনুন্নত দেশগুলাে হচ্ছে ক্রেতা, বড় বড় রাষ্ট্র হলাে বিক্রেতা। জাপান ও চীন ছাড়া এশিয়ার প্রায় সব দেশই ক্রেতা। ভারতবর্ধও নানা দুর্বিপাকের মধ্যে দিয়েও উন্নতির দিকে। পৃথিবীর কোনাে রাষ্ট্রই চায় না সমস্ত দিক থেকে ভারতবর্ষ এগিয়ে যাক, স্বনির্ভর হােক। ভারতবর্ষ যদি স্বনির্ভর হয় তাদের মাল কাটবে না। ঠিক তেমনি পাকিস্তানের অবস্থা। বড় বড় রাষ্ট্র দয়ার দান দিয়ে পাকিস্তানকে নির্মমভাবে শশাষণ করছে যার অংশীদার পাকিস্তানের যুদ্ধবাজ শাসনচক্র এবং কয়েক ঘর শিল্পপতিরা পাকিস্তানের সােনারখনি হলাে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যাক এ পৃথিবীর কোনাে রাষ্ট্রই চায় না। বাংলাদেশ ছাড়া পাকিস্তান মৃত হয়ে যাক এ তারা কখনই চায় না। সেই জন্য বাংলাদেশের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে তারা বলে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ঘরােয়া ব্যাপার।
আগুনে পুড়ে পুড়ে আজ বাংলাদেশ খাটি সােনা। এই সােনার ঝকমকে আলােকে আন্তর্জাতিক বণিকগােষ্ঠী কোনাে ক্রমেই বরদাস্ত করতে চায় না। তাদের মুখােস খুলে পড়ছে। দেখা যাচ্ছে স দগদগে ঘা। ভারতবর্ষ যতই ভুল করুক না কেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে তার যতই দেরী হােক না কেন অন্তত মানবিক দিক থেকে সে শুদ্ধ। এই শুদ্ধতাও বণিকী রাজনীতি মেনে নিতে রাজী নয়। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে এলে ভারতের উন্নতিমুখী অর্থনীতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। ঠিক এইটেই চায় তারা। সেই জন্যই বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের হাত মেলাতে পরস্পর বৈরী গণতান্ত্রিক (?) চীন ও আমেরিকা এবং গ্রেটব্রিটেন একটি ত্রিকোণে এসে মিলে গেছে।
এর জন্য দায়ী আমাদের কুটনৈতিক ব্যর্থতা। যুদ্ধবাজ পাকিস্তান যখন বাংলাদেশকে রক্তে রাঙিয়ে দিতে শুরু করল, ঠিক সঙ্গে সঙ্গে কোনাে দ্বিধা না করে যদি বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দিতাম তবে আমরা এক ঢিলেই পাকিস্তান ও চীনকে কুটনৈতিকভাবে পরাজিত করতে পারতাম। আমরা তা পারিনি বলেই পাকিস্তান ও তার দোসর আন্তর্জাতিক বণিকী-রাজনীতি-গােষ্ঠী এক ঢিলে দুই পাখি মারবার তালে আছে। বাংলাদেশের আত্মবিকাশকে যেমন তারা হত্যা করতে চায় তেমনি লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে ভারতের মাটিতে ঠেলে দিয়ে আমাদের সর্বাত্মক উন্নতির পথটিকে আটকে দিতে চায়। আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতাই এই সুযােগ করে দিয়েছে।
তবু সময় এখনাে পেরিয়ে যায়নি। যুদ্ধকালীন সময়ে মিত্রপক্ষ যদি দ্যগলের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারে, নেতাজীর আজাদহিন্দ ফৌজকে আয়ারল্যান্ড যদি মেনে নিতে পারে, সম্প্রতি ঢাল নেই তলােয়ার নেই এমন প্রিন্স সিহানুককে চীন যদি স্বীকৃতি দিতে পারে তবে নিজেদের মাটিতে দাঁড়ানাে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সরকারকে আমরা কেন মেনে নিয়ে সব রকম সাহায্য দিয়ে, তাদের বাঁচবার অনেক সুযােগ দিয়ে নিজেদেরও এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশ চক্রব্যুহ থেকে মুক্ত হবে না।

সূত্র: কম্পাস, ১৯শে জুন ১৯৭১