ভারত সােভিয়েত চুক্তি ও বাংলাদেশ
অমর রাহা
দীর্ঘ দু’বছর ধরে ভারত ও সােভিয়েত দেশের মধ্যে এই চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা, আলাপ-আলােচনা চলছিল। অথচ, আমাদের বামপন্থী তরফ হতে ভারত মহাসাগর এলাকার বিঘ্নতার ব্যাপারে, এই উপমহাদেশে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তিক্ততাজাত সংকট বা অর্ধসংকট অবস্থা ব্যাপারে বা সি-আই এ + পাক সামরিক চক্রসৃষ্ট মিজো-নাগা ব্যাপারজাত ভারতের পূর্বাঞ্চলে সংকট সৃষ্টি সম্ভাবনা প্রভৃতি ব্যাপারে যে এমন ধরনের চুক্তির প্রয়ােজন ছিল তা নিয়ে সারা দেশে কোনােরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম তাে হয়নি, বরং এদিক দিয়ে দীনতারই পরিচয় দিয়েছে। দ্বিতীয়ত সিনাে ইনডিয়ান মনােমালিন্য ও সংঘর্ষ এবং নাগাঅঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ শিক্ষান্তে নাগাবৃন্দকে চীনে হতে পাঠান। নকসালে কার্যাবলীকে পিকিং বেতার হতে ভারতের বিপ্লব সম্ভাবনা বলে প্রচার ব্যাপার মিলেও এমন পরিবেশ হয়েছে যার জন্যও প্রয়ােজন ছিল এমন এক জাতীয় চুক্তি।
কিন্তু এই প্রয়ােজনকে সাধারণ নাগরিক বা তাঁদের বামপন্থী মুখপত্রাদি ও নেতৃবৃন্দ ভাষা দিতে অক্ষম বলেই প্রমাণিত হয়েছেন। অতএব, এদিক দিয়ে ইন্দিরা-নেতৃত্ব বিচক্ষণতার পরিচয়ই দিয়েছে। তাছাড়া সময় ও ক্ষণ খুবই অনুকূল হল বাংলাদেশ ব্যাপার নিয়ে যখন ইসলামাবাদ বেশ রণহুঙ্কার দিচ্ছিল; ফলে দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলও এই চুক্তির বিরােধিতা করতে সক্ষম হয়নি যদিও রক্ষণশীল ডি, এফ, কারকা একে বলেছে: A kiss to day, a stab tomorrow- অর্থাৎ, আজকের বন্ধু, আগামীকালের হত্যাকারী।
যাক, এই চুক্তিতে অনুচ্ছেদ হলাে বারটি অনুচ্ছেদ ১ হলাে : সার্বভৌমতু, স্বাধীনতা এবং টেরিটরিয়াল ইনটেগ্রিটির ব্যাপারে উভয়ে পরস্পরের স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে দেবে না; আর কারও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপও করবে না। অনুচ্ছেদ ২: এশিয়া ও বিশ্বে শান্তি রক্ষার ব্যাপারে উভয় দেশ দৃঢ়তার সঙ্গে অনুকূল নীতি অনুসরণ করবে।
অনুচ্ছেদ ৩ : উপনিবেশবাদ ও বর্ণবিদ্বেষ যে ভাবেই যা যেরূপেই দেখা দিক না কেন উভয় দেশের কাছে সর্বদাই নিন্দনীয় আর উপনিবেশবাদ ও বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে যে জাতি ও দেশ তার আশাকাআত্মার জন্য সংগ্রাম করবে উভয় দেশই তাদেরকে সাহায্য করবে [Shall cooperate with other states to achieve these aims and to support the just aspirations of the peoples in their struggle against colonialism and racial domination) |
এখানে প্রসঙ্গত বলা অযৌক্তিক হবে না যে জাগ্রেব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাদোভান পাভি মনে করেন: অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণাবলীর দিক হতে পূর্ব পাকিস্তান সব সময়ই অনুভব করেছে যে সে হলাে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ ..[অতএব নতুন, পূর্ব পাকিস্তান যদি রাষ্ট্র বা এখনকার বাংলাদেশ] উক্ত উপনিবেশজাত অবস্থা হতে মুক্ত হয়ে আসতে পারে তবেই দেখা দেবে স্বাধীন নব জীবন [ a new East Pakistan State, free from such problems, would be in a much more favourable position and this element should certainly be added to the favourable factors at the beginning of its eventual independent life.]
অনুচ্ছেদ ৪ : সােভিয়েত ভারতের জোট নিরপেক্ষতা নীতিকে সম্মান তাে করেই এবং সঙ্গে সঙ্গে এও দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করে যে বিশ্ব শান্তি, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করার ব্যাপারে উক্ত জোট নিরপেক্ষতার নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
অনুচ্ছেদ ৬ পরস্পরের সহায়ক ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতির সম্প্রসারণ করার জন্য উভয় দেশের অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও টেকনলজি সংক্রান্ত ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান সহযােগিতার প্রয়াস বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা থাকবে।
অনুচ্ছেদ ৯ : উভয় দেশের কেউ আক্রান্ত হলে বা সম্ভাবনা দেখা দিলে উভয় দেশ যেমন পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করবে, ঠিক তেমনি শান্তি ও দেশের নিরাপত্তার জন্য সর্ববিধ ব্যবস্থাও করবে।
-অন্যান্য যে সকল অনুচ্ছেদ আছে তা হলাে একে অন্যের পরিপূরক। আর, অনুচ্ছেদ ১১ হল চুক্তির মেয়াদ [২০ বছর) এবং অনুচ্ছেদ ১২ হল রীতিসিদ্ধ বা ফরম্যাল।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ৩নং অনুচ্ছেদ + ৯নং অনুচ্ছেদ মনে হয় অনুধাবন করা প্রয়ােজন। তবে অনেক সুধীজন বা সমালােচক আছেন যারা হয়ত এ জাতীয় অনুধাবন করাকে তাদের মতে যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার নয়। হয়ত তাদের অত্যুগ্র ইচ্ছার খােলাখুলি প্রকাশই পছন্দসই। কিন্তু, কোনাে চুক্তি যদি সাময়িক ঘটনার জন্য না করা হয় তবে সেই চুক্তি কখনও সেই সময়কার ঘটনাকে উল্লেখ করে না। বাংলাদেশ সংগ্রামজাত অবস্থা এক ধরনের, আর বাংলাদেশের সংগ্রামের মূল অন্য জাতের। শেষােক্ত ব্যাপার বা মূলই প্রকাশিত হয়েছে উপনিবেশবাদ শব্দের মধ্যে দিয়ে। আর যারা জোট নিরপেক্ষ- তার ওকালতি করেন এবং ভারতীয় সংবিধানের কথা স্মরণ করেন তাদের পক্ষে ভারত-সােভিয়েত চুক্তির ৪নং অনুচ্ছেদ অনুধাবন করাই বােধ হয় ঠিক। তাছাড়া, অনেক সমাজতান্ত্রিক জগতের তথাকথিত চুপ করে থাকা পছন্দ করেন না। সমাজতান্ত্রিক জার্মানির ডাক্তার হেইনার ভিলার “বেরলিনারৎসাইতুং-এ [১৯৬১, ১৫ই জুলাই) বাংলাদেশের সগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রাম বলেই উল্লেখ করেছেন। এমনি ধারণা বা বিশ্লেষণ হলাে যুগােশ্লোভিয়ারও এবং…। এক আলবেনিয়া, রুমানিয়া ছাড়া পূর্ব ইউরােপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের দৃষ্টিভঙ্গি কী জাতীয় তা বােঝা সম্ভব। তবে প্রশ্ন হচ্ছে স্বীকৃতির। এদিক দিয়ে নানাদিকের কথা যেমন ভাবা উচিত, ঠিক তেমনি বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা বা লবিইংও অনুধাবন করা যুক্তিসঙ্গত।
সুদূর প্রসারী হলাে এই চুক্তি, যেমন বাংলাদেশের সংগ্রামও হলাে সুদূর প্রসারী এবং নবদিগন্ত উন্মােচনকারী।
সূত্র: কম্পাস, ৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯৭১