You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের এই সংগ্রামে : এই সংকটে
কুণ্ঠাহীন সাহায্য দিতে হবে
নুরুল আলম

পূর্ব সীমানার ওপার এবং এপারের সংকট দিনে দিনে জটিল চেহারা নিচ্ছে। ত্রিশ লক্ষ পার হয়ে গেছে ছিন্নমূল শরণার্থীর সংখ্যা। হিন্দু, মুসলিম, নারী, শিশু বৃদ্ধা, অসুস্থ মানুষ হাজারে হাজারে দলে দলে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসছেন সীমানার এপারে। পাঠান পাঞ্জাবী বালুচ জল্লাদ বাহিনীর অবর্ণনীয়, অসহ্য অমানুষিক অত্যাচারের মুখে অসামরিক, নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ টিকে থাকবে একথা ভাবাই যায় না। একটি সজ্জিত সশস্ত্র বাহিনী বােমারু বিমান, ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, মর্টার সহযােগে যে জনবিরােধী সর্বাত্মক যুদ্ধ নিরীহ মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, নামিয়ে এনেছে অত্যাচারের অনিবৰ্চনীয় পেষণ ক্রিয়া তা প্রতিবাদ, নিন্দা, ধিক্কার, বিক্ষোভ, উত্তেজিত বক্তৃতা বা ভাষণ দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। আমরা এ পর্যন্ত সেই সীমানার মধ্যে আমাদের কর্তব্য পালন করেছি। বলতে গেলে পুরােমাত্রায়। তাতে কিছু ফল নিশ্চয় হয়েছে, বিশ্ব জনমত সচেতন হয়েছে। কিন্তু অত্যাচার বন্ধ হয়নি। বেড়েছে ক্রমে ক্রমে। আজ সে অত্যাচার যে সীমাহীন, তুলনাহীন বর্ণনাহীন একটা পর্যায়ে চলে গেছে সে কথা চলে আসা লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে। সাধারণ সাংবাদিক, রেডিও নিউজ রিল থেকে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্র সংঘ প্রতিনিধিদল সবাই তুলে ধরেছেন ওদের করুণ কাহিনী দুর্দশার কথা, সবাই জানছেন ওপারের সাত কোটি মানুষের শােচনীয় জীবনের অভিজ্ঞতা। দেখছেন এপারের পরিস্থিতির শিকার বিপুল সংখ্যক মানুষের অবস্থা।
ওদের প্রয়ােজন খাদ্য, ঔষধ, কাপড়, থাকার ঠাই, সম্ভব মতাে কিছু কাজ। মুক্তি বাহিনীর জন্য প্রয়ােজন এগুলাে সহ রক্ত, অস্ত্রশস্ত্র, ট্রেনিং এবং আরও অনেক কিছু।
মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবে। এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবেই নিজের অধিকারে। আলজিরিয়া যদি স্বাধীন হয়ে থাকে, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ যদি সাফল্যে ভাস্বর হয়ে থাকে তাহলে ইতিহাসের এজলাসে কোনাে অপরাধে পরাধীনতার বেড়ি পরবে বাংলাদেশ?
দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের জন্য ব্যাপক, ও বিপুল প্রস্তুতি প্রয়ােজন। নিরন্তর রাজনৈতিক সহযােগিতা ওদের সাফল্যের গ্যারান্টি। সেই সঙ্গে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ অসহায় নারী পুরুষের। দায়িত্ব নিতে হবে তাদের খাদ্য, ঔষধ, বাসস্থান যােগানাের।
কে নেবে এই দায়িত্ব? উত্তর স্পষ্ট। তা সারা বিশ্বমানবতার দায়িত্ব। সমস্ত রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্র সংঘ সে কাজ প্রত্যক্ষভাবে করতে বাধ্য যদি মানবতা রক্ষার ব্রত তার কাজ হয়ে থাকে। কিন্তু আজও সে সাহায্য এসে পৌছায়নি ওদের কাছে। পৃথিবী নির্বাক। অপরাধমূলক অপরিচ্ছন্ন আবেষ্টনে আচ্ছন্ন করে রাখতে চাইছে নিজেদের মানবিক দায়িত্বকে। বিশ্ববিবেক এ অপরাধের কৈফিয়ৎ নিশ্চয়ই একদিন চাইবে।
রাষ্ট্রসংঘ, কমনওয়েলথ আফ্রোএশীয় দেশগুলাে বিভিন্ন সময়, বহু সংকট নিয়ে আলােচনায় বসে, বিতর্কে মাতে। দক্ষিণ আফ্রিকা, রােডেশিয়া, এ্যাঙ্গোলা, বায়াফ্রা ইত্যাদির হত্যা নিয়ে নির্যাতন নিয়ে এরা আলােচনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে এরা নীরব কেন বুঝতে বিবেক জ্বলে উঠছে। নীরব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে। চিঠিপত্র ও রাজনীতিক চাল দিয়ে গোয়ার জঙ্গীচক্রকে সংযত করা যাবে এ ধারা যাদের এবং যেসব রাষ্ট্রনেতা মানুষের পাশে দাঁড়াতে সাহস করে না সেই ভীরুদের রাজনীতিক বলতে বাধে নাকি?
এসে পড়ে ভারত সরকারের কথা। শুরু থেকেই নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন ভারত সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের। যারা পাক-চমুদের অত্যাচারে দেশত্যাগ করছেন তাদের দায়িত্ব ভারতের উপর এসে পড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সজাগ করে তােলার রাজনৈতিক চেষ্টাও হয়েছে। স্বীকৃতির প্রশ্ন বিবেচনাধীন। অবিলম্বে সে স্বীকৃতি আমরা দাবি করছি। সেই সঙ্গে আরও বৃহৎ সংকট সৃষ্টি হবে কি না সে বিষয়ে বারবার ভাবতে বলি। ভুল যেন না হয় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ঠিক সময়ে। বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানাের দায়িত্ব আমাদের একথা বিস্মৃত হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। তাই দ্বিধা নয়।
এই কাজে আর যারা নীরব তাদের সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। বাংলা তথা ভারতের বেশ বড় সংখ্যক মুসলিমরা মনমরা হয়ে পড়েছেন ও-বাংলার ঘটনায়। লজ্জা করে না এদের। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় এই সমাজের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর যারা এদের জন্য লড়াই করেন। লজ্জিত আজ বাংলার মুসলিম যুবসমাজ। জানি না এ বাংলার মুসলমানরা কবে সত্যিই সচেতন হবে? জানা সম্ভব নয় আরও কতবার ভুল রাজনৈতিক চিন্তায় ডুবিয়ে মারবে এই জাতটাকে? এদের অনীহা ও নেতিবাচক চালচলনে নিরুৎসাহ হয়ে অনেক চিন্তাবিদ মুসলিম আজ এদের থেকে বিচ্ছিন্ন! বিগত দুশাে বছরে এ ধরনের ঘটনা বহু আছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। ইসলামী ধর্ম ও সভ্যতা মধ্যপ্রাচ্যে অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে যে গতিশীল সমাজের পত্তন করেছিল ধর্মের প্রতি অন্ধ মােহ, ভ্রান্ত ধারণা, বিকৃত ধর্মসম্পর্কহীন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, অশিক্ষিত মুসলমানরা সেই গতি ও শক্তিকে কানাগলির অন্ধকারে হত্যা করতে আজ উদ্যত। পরিবর্তন সমাজের সাধারণ নিয়ম। এরা তাও মানতে রাজী নয়। এমন কি নিজেরা অনেকখানি বদলে গিয়েও মানবে না যে তারা বদলেছে। কিসে কতখানি বদল দরকার সে আলােচনা আপাতত অবান্তর। মানুষের চিন্তা ও ভাবনায় যে পরিবর্তন ঐতিহাসিক নিয়মে সৃষ্টি হয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও ব্যক্তিজীবন সব কিছুতেই সেই পরিবর্তন ছায়া ফেলে। মানুষের বাঁচার তাগিদ মিটাতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, বাঁচার তাগিদেই তা পরিবর্তিত হয়েছে। পৃথিবীর বহু সভ্যতা অন্তত পনের বিশটি, ধ্বংস হয়ে গেছে বদলাতে পারেনি বলে। আবার টিকে আছে অনেকগুলাে সময়ােপযােগী পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছে বলে। মুসলিম সমাজের সামনে সেই দৃষ্টান্তটা তুলে ধরতে চাইছি ইতিহাস থেকে। শিক্ষিত মুসলিমরা নিশ্চয়ই তা ভেবে দেখবেন।
এই আলােকেই বিচার করতে হবে ও বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাকে। ইরান তুর্কী শাসনে যেমন পাকিস্তান থাকা সম্ভব নয় তেমনি পাকিস্তানের শাসনে বাংলাদেশ থাকতে পারে না। পারবে না। কারণ পার্থক্য অনেক রকমের। ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ভাষাগত, এমন কি ঐতিহাসিক পটভূমিটিও ভিন্ন। ও বাংলার মানুষ নব্য সংস্কৃতি ও নবজাগরণের দ্বার উদঘাটন করছিল। বুদ্ধি মুক্তি’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ঢাকায় ঘটেছে। বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে চলে পঞ্চাশ দশকে, তা নূতন চেহারা নিল বাংলাভাষাকে কেন্দ্র করে। সেই থেকে উদার মানবতাবাদের ভিত্তিতে, কারাে ধর্ম বিশ্বাসকে আঘাত না হেনে, অর্থনৈতিক ভাগে কাউকে শােষণ না করে, রাজনীতিক মর্যাদা কারাে কেড়ে না নিয়ে একটা সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার যে সংকল্প ওরা নিয়েছিলেন, যার বুনিয়াদ রচিত হয়েছিল ও বাংলায় তা যেমন তাৎপর্য পূর্ণ ও বাংলার হিন্দু মুসলমানের জন্য, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বমুসলিম সমাজের জন্য। এ কথাটা ঠিক মতাে অনুধাবন করা হচ্ছে না কোনাে মুসলিম দেশে। অনুধাবন করা হয়নি এ বাংলার মুসলিম সমাজের বিরাট অংশে। যদি ওদের নব জাগরণের তাৎপর্য বুঝতেন তাহলে নিশ্চয়ই চুপ করে থাকতেন না। ইয়াহিয়া ভূট্টোর অত্যাচার আর কুটরাজনীতির বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে কুণ্ঠা থাকতাে না।
মুসলমানদের মধ্যে যারা চুপ করে আছেন তাদের জিজ্ঞাসা করি এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের কোনাে সমস্যার সমাধান দেবে কিনা। অন্য দিকে মুজিবর রহমানের রাজনীতিকে সমর্থন করলে কী সুফল পাওয়া যেতে পারে তা ভেবে দেখুন।
সত্য কথা এ বাংলায় মুসলমানদের অনেক ক্ষোভ আছে। কিন্তু একথা কি আরও বড় সত্য নয় যে, বাংলার হিন্দুরা আরও অধিক সমস্যায় জর্জরিত। প্রতিদিন যে হিংসাত্মক রাজনীতির লেলিহান শিখা প্রতি মহল্লায় প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে তাকি সুখের হৃৎসব? হত্যাকাণ্ড বােমাবাজি, জেল খাটা কোনাে সুখী সমাজের সৌখিন বিলাস হতে পারে না। ওরা খুব সুখে আছেন এই ধরনের ভাবনার পুরানাে স্বভাবটা ত্যাগ করা অনতিবিলম্বে বাঞ্ছনীয়। সঙ্কট উভয় সমাজে আছে। সমস্যায় গােটা দেশ জর্জরিত। এজন্য দায়ী কোনাে বিশেষ সমাজ বা সম্প্রদায় নয়। দাবী সমগ্র রাষ্ট্রকাঠামাে, সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সাধারণ নিয়মে সমাজে সৃষ্টি হয়-অনাচার, অত্যাচার, শােষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও হতাশা। সমস্ত কিছুর স্থায়ী সমাধান নিন্ত্র করে পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে ব্যক্তি মালিকানার বিলােপ, কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক-উৎপাদন ও বন্টন প্রক্রিয়া চালু করা। তা যতদিন না হচ্ছে ততদিন ভুগবে মানুষ। কখনাে ধর্ম, কখনাে ভাষা, কখনাে আঞ্চলিকতার মােহ বিভ্রান্তিও বিপথগামী করবে মানুষকে। সব বিষয়টা তলিয়ে দেখবার জন্য আমরা যেন সচেতনভাবে ঘটনাগুলােকে বিচার করি। আমাদের রেডিও সংবাদপত্র এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সে দায়িত্ব পালন করলে মানুষ পথ খুঁজে পাবে। বিভ্রান্তি কাটিয়ে সাহায্যে ও সহযােগিতায় এগিয়ে যাবে।
ও-বাংলার এই সংকটে তাই এ বাংলার মুসলিম সমাজের দায়িত্ব হিন্দুদের পাশাপাশি সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া। যুবসমাজ এদের সচেতন করে তুলতে একটা সম্মেলন করলে কেমন হয়? সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিলে এদের রাহুগ্রাস কাটবে না কোনােদিন। সবাইকে এইসব দ্বিধা থেকে মুক্ত হতেই হবে।

সূত্র: কম্পাস, ১২ই জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!