মুক্তিযুদ্ধ
দিলীপ সেনগুপ্ত
এই শহর কলকাতায় আমরা যারা একটু খোঁজখবর রাখি, তাদের কাছে এ কথা অজানা নয় যে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য তরুণ অধ্যাপক, ছাত্রযুবক কোথাও আত্মীয়ের আবাসে, কোথাও সহায়ক-সমিতির আশ্রয়ে কালযাপন করছেন। ওরা এভাবে বৃথা কালাতিপাত করুক এটা বােধ হয় আমাদের কারাে ইচ্ছেই নয়। আমরা একটু হতাশ হই। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজনীয় শক্তিকে কলকাতায় ক্ষয় হতে দেখে দুঃখ প্রকাশ করি।
কিন্তু সব ধারণা বদলে যায় যখন শুনি, বহু ছেলে আসছে—আমরা তাে কতজনকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। কথাটা বলেন ওমর আলি। বাংলাদেশের কোনাে এক গাঁয়ের অভ্যন্তরে এক মুক্তিযুদ্ধের দপ্তরে বসে।
অফিসে ঢুকে হাত জোড় করে নমস্কার করতে একটু দ্বিধা বােধ করি। যে গুটি কয়েক ছেলে মাদুর পাতা একটি চৌকির ওপর বসে অফিস আগলাচেছ তাদের কারাে বয়সই বিশের বেশি নয়।
আমাকে বসিয়ে একজন ছুটল কর্তাকে ডেকে আনতে। ইত্যবসরে ওই অল্প বয়স্কদের একজন বহু চেষ্টার পর কুণ্ঠাভরে জিগ্যেস করে বসল, কি মনে হয় দাদা, আমরা কি ফিরতে পারব?
‘নিশ্চয়ই পারবেন।’
তখনই ব্যস্ত পায়ে ঢােকেন মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোেক? পরনে লুঙ্গি আর ফিকে নীল রঙের প্রায় ময়লা শার্ট। পায়ে কাদা। বুঝলাম, নানান কাজে ব্যস্ত। জল কাদা মাড়িয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
আলাপ হলাে। ইনি ওমর আলি। এই অফিসের ভার তার ওপর। মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবার জন্য সাড়া পাচ্ছেন কেমন?’ জিগ্যেস করলাম।
‘ওরে বাব্বা! সব স্কুল-কলেজের ছাত্র দলে দলে আসছে বলে, যুদ্ধে যাবাে। ট্রেনিং চাই। আমরা তাে এ পর্যন্ত কতজনকে ফিরিয়ে দিয়েছি।’
‘কেন ফেরাচ্ছেন কেন?
এক নম্বর সকলের স্বাস্থ্য উপযুক্ত নয়, দু নম্বর রাখা-খাওয়াবার প্রশ্ন আছে। থামলেন ওমর আলি। আমি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলাম, পশ্চিম বাংলার কেউ নাম লিখাতে এসেছেন?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব, “অনেক, আমরা লেখাইনি। বলছি, পরে হবে। এখন নয়।’
এরপরে আর তেমন কিছু জিজ্ঞাসা রইল না। উঠে পড়লাম। আমায় খানিকটা পথ এগিয়ে দিলেন ওমর আলি। তার হাতের টর্চে সামনের মেটে পথ আলােকিত হয়ে উঠল। এমনিতে অন্ধকারে। বিজলী আসেনি।
‘আপনারা যাদের ট্রেনিং দিচ্ছেন, তারা কি ক্যাম্পেই থাকছেন না ওয়ার ফ্রন্টে যাতায়াত করছেন? আমার এ প্রশ্নে হাসলেন ওমর আলি। বিনীতভাবে বললেন, কিছু মনে করবেন না এটা বলতে পারব না।’
মনে করা দূরের কথা, খুশিই হলাম। কেননা, সাবধান হবার যথেষ্ট প্রয়ােজন আছে। আর এঁরা তা হয়েছেনও।
অনেক রাত হলাে ফিরবেন কী করে? ওমর সাহেবের প্রশ্নে আমারও চৈতন্য হলাে। আমিও থেকে থেকে সেই কথা ভাবছিলাম। থাকার জায়গা যে কোনাে সমস্যা নয়, একটু পরেই তা বুঝতে পারলাম। ওমর আলি আমায় নিয়ে উঠলেন কাসেম মিঞার অফিসে। আড়ালে কথা বললেন ওঁরা। খানিক পরে কাসেম মিঞা বললেন, ‘আপনার কিন্তু কষ্ট হবে।’
এ কথার কোনাে জবাব হয় না। নেহাতই বিনয়। আর সত্যিও তা যদি হয়, তবে আমার কাছে লজ্জা। রাত এগারােটারও পরে খাকি পােশাক পরা জনা দশেক তরুণ ঢুকলেন। কাসেম আলি বললেন, মুক্তিযােদ্ধা। এখানে ঘুমােবে।’ একটু থেমে আবার বললেন, “আমাদের সঙ্গে কথা না বলে এদের কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।’
রাতের শেষ প্রশ্নটি করলাম, ‘ট্রেনিং ক্যাম্প কি কাছেই? সকালে নিয়ে যাব।’
খুব ভােরে ঘুম ভাঙল। দেখলাম, রাতের মুক্তিযােদ্ধারা কেউই নেই। কাসেম মিঞা চৌকিতে বসে আনমনে কি ভাবছেন যেন।
‘উঠেছেন? ওই যে জল মুখ হাত ধুয়ে চলেন যাই ট্রেনিং ক্যাম্পে।
ট্রেনিং ক্যাম্প। পূর্বতন কোনাে এক বিদ্যায়তন। ফটকের দু পাশে দু’জন অত্যন্ত কচি বয়সী পাহারা। হাতে বন্দুক নয়। তবে বন্দুকেরই মডেল। দূর থেকে বন্দুকই মনে হয়। এমনভাবে লাঠি দুটি কাটা।
ভেতরে হই রই ব্যাপার। বেশির ভাগ তরুণ। দু’ একজন বয়স্কও চোখে পড়ল। আরও ভেতরে অফিস ঘর।
এই ক্যাম্পের চার্জে আছেন আবদুল হােসেন। সকালে স্নান সেরে অফিসে এসে বসেছেন। ওমর আলি পরিচয় করিয়ে দিতে বললেন, আপনার আইডেনটিটিটা একটু দেখাবেন।
কড়া নজর। কার্ড দেখালাম। স্বস্তি বােধ করে কথা পাড়লেন, বলেন -কি জানতে চান?
‘এখানে আপনারা কতজনকে ট্রেনিং দিচ্ছেন? দুশ। জবাব দিয়েই বাইরে মুখ বাড়িয়ে একজনকে ডাকলেন হােসেন সাহেব। বলিষ্ঠ চেহারার একজন আমাদের সামনে সােজা হয়ে হাজির হল।
‘এই যে নামটা বলতে পারব না, এ ছিল রাজশাহীতে। জেনােসাইডের সময় ওখানে ছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের।
ডাকলেন আর একজনকে। মাথার চুলে পাক ধরেছে। এ ছিল আপনার চট্টগ্রামে হাবিলদার এরাই ট্রেনিং দিচ্ছে।’
তক্ষুণি আর একজন ঐস্ত হয়ে ঢুকে বললেন, মান্নান না বলে ক্যাম্প থেকে চলে গেছে—ওকে বাদ দিয়ে দিন। উত্তেজিত সংবাদদাতাকে দমিয়ে দিলেন হােসেন সাহেব ‘ওর নামে একটা টিক দিয়ে রাখাে।’
ব্যাপার কী?’ আমি আর না জিগ্যেস করে পারলাম না।
মাইলখানেক দূরে কাল রাত্রে মুসলিম লীগের এক গুপ্তচরকে ধরে আনা হয়েছে। এখন তার বিচার হবে। হােসেন সাহেব বললেন, ছেলেমানুষ- সেখানেই গেছে হয় তাে। অনুমতি চাইলে পেত না-তাই না বলেই গেছে।
আপনারা স্পাই ধরে কী করছেন?
আমার এ প্রশ্নে অনেকক্ষণ মনােযােগ দিয়ে আমাকে দেখলেন হােসেন সাহেব। তারপর ইশারায় বললেন, ‘বুঝতেই তাে পারেন, ওদের সাজা কী হতে পারে?
এবারে অন্য প্রসঙ্গে এলেন। বললেন, কাল একটি ছেলে এসেছিল নামটা মনে নেই, সে যুদ্ধ করবে। আমি বললাম, না এখন আর দরকার নেই। ছেলেটি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। তারপর তাকে বলা হলাে, তােমাকে একটা কাজের ভার দেয়া হবে তা যদি পারাে তবেই নেওয়া হবে। তখন হাসল ছেলেটি।
ঘটনাটির বর্ণনা দিতে বক্তার নিজেরও বােধ হয় খুব ভালাে লাগল। ভালাে লাগারই কথা। মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। যারা আসছেন, তাদের ভেরিফাই করছেন কী ভাবে?
সূত্র: কম্পাস, ১৯শে জুন ১৯৭১