সভাসমিতি
বাংলাদেশ ও জমিয়ত উলামা
অমর রাহা
‘খিশত্ আউয়াল চুম নেহাদ মেহমার-কাহ্ তা’ সুবাইয়া মীর রহওয়াদ দিওয়ারকা” অর্থাৎ ভিত্ যার বাঁকা তার চূড়া আকাশচুম্বী হলেও বাঁকা থাকবেই বলেছেন শেখ সাদী। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ জমিয়তে উলামার কনভেনশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মওলানা মােহম্মদ তাহের সাহেব বলেছেন: “গােড়ায় যার গলদ রহিয়াছে, তাহার শেষ শােধরান সহজ নয়, সমাপ্তি তার সুন্দর হইতে পারে না।” একথা মওলানা বলেছেন পাকিস্তানের জন্ম ও ইতিহাস মনে করে এবং তারই ভাষায় “একদা যে স্বার্থান্ধতা ও ক্ষমতা লিপ্সা সাম্প্রদায়িকতার নামে দেশ বিভাগ এবং পাকিস্তানের জন্ম দিয়াছিল, আজ সুদীর্ঘ তেইশ বৎসর যাবৎ পাকিস্তানের ইতিহাসে তাহা বারে বারে নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সেই উগ্র ক্ষমতা লিপ্স এবং স্বার্থপরতাই ক্রমপরিণতি।”
সােনার বাংলা শ্মশান কেন?
…ধর্মের নামে, ইসলামের নামে, দেশের ঐক্য সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার নামেই এই শােষণ এবং অবিচার চলিয়াছে। অথচ যে পবিত্র ইসলাম এবং ধর্মের নাম দিয়া এই শশাষণ সেই পবিত্র ইসলাম ধর্মে কিন্তু ইহার অবকাশ মাত্র নাই।…প্রিয় নবী (দ.) স্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করিয়াছেন: যে রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সরকার তাহার প্রজা সাধারণের কল্যাণ প্রচেষ্টা করে না, তাহাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, নরকের আগুনই তাহার নিশ্চিত ঠাই।
তাই প্রতিবাদ
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।
তাহের সাহেব তাই হদীস শরীফ উল্লেখ করে বলেন: অত্যাচার অবিচার চুপ করিয়া সহ্য করিতে নাই; অত্যাচার অবিচারের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করিতে নাই; ইহাতে সমগ্র সমাজের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।
…অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ কাপুরুষতা প্রদর্শন না করিয়া যাহাতে সৎ সাহসে আগাইয়া আসে তজ্জন্য উৎসাহ দান হুজুর (দ.) ঘােষণা করিয়াছেন: জালিম রাষ্ট্রনায়কের সম্মুখে সত্য কথা ঘােষণা শ্রেষ্ঠতম জেহাদ।”
তাই দেখা যায় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি হতে ১৯৬৯ সালের ১৯ ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নানাভাবে এবং জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় এবং ঘােষিত বা অঘােষিত জেহাদ। আর শেষত ২৩ বছর পর সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ রায় দিলাে ছয়দফার পর। শেখ মুজিব নেতৃত্ব হল এই দীর্ঘ সগ্রামের প্রতীক।
ইসলামাবাদ চত্রু ও শেখ মুজিব
ইসলামাবাদ চক্র প্রতিনিধি জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ভাষাকে এবং রায়কে পদদলিত করবার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে “সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের দলনায়কদের সঙ্গে পরামর্শ মাত্র না করিয়া” জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দিলেন। তাছাড়া, ইয়াহিয়া শেখ মুজিবরকে প্রধান মন্ত্রীত্বের টোপ দিয়া ছয়দফা দাবি হইতে বিচ্যুত করিতে চেষ্টা করিলেন কিন্তু, “জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করিয়া তিনি স্পষ্ট জবাব দিলেন: জাতি আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে প্রধান মন্ত্রীত্বের জন্য ভােট-দেয় নাই, তাহারা ছয়দফা দাবীকেই ভােট দিয়াছে; আমি তাহা বিসর্জন দিয়া জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারিব না।’
তাহের সাহেব তাই বললেন: ইহাতেই শােষকের আঁতে ঘা পড়ে; তাহারা ভাবে ব্রিটিশ সরকারকেও একদা যে অসহযােগ আন্দোলনের অস্ত্র শেষ পর্যন্ত ঘায়েল করিয়াছে, ভারত ছাড়া করিয়াছে, শােষিত বাঙালিরা যদি সেই অস্ত্র ব্যবহার করে তবে আর রক্ষা নাই, ইহাতেই জেঁকের মুখে চুন পড়িবে..। অতএব সূচনাতেই সামাল দাও; এই শােষিত অবাধ্য বাঙালি জাতিকে ডাণ্ডা মারিয়া ঠাণ্ডা করিয়া দাও…তাহাদের মেরুদণ্ড ভাঙিয়া দাও।”…এবং বাঙালি নিধনের নির্দেশ দিয়া ইয়াহিয়া ঢাকা হতে করাচী যাত্রা করেন।
সবই চলে ধর্মের নামে
ইসলাম ধর্ম …রক্ষা নামেই ইয়াহিয়া সবকিছু করিতেছে। শিশু হত্যা, নারী ধর্ষণ, নিরপরাধ জনতা নিধন, বাঙালি নিধনের নামে সবই চলিতেছে। “তাহারা মজলুমকে ঠাণ্ডা এবং জগৎ কে ধোঁকা দিবার জন্য একই সঙ্গে বন্দুকের গুলি এবং ধর্মের বুলি ব্যবহার করত মজলুমের-শােণিতে রক্তের হােলি খেলিতেছে। বাংলাদেশের সর্বত্র চলেছে তাহাদের এই পৈশাচিক নৃত্য।
জেহাদ ও মুক্তিবাহিনী
প্রায় ২৩ বছর ধরে যে অব্যক্ত ও জেহাদ চলে আসছিল তাই ২৫শে মার্চের রাতে রূপ নিল ভিন্নভাবে।
ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতা ও বুলেটের গুলির পরিবেশে জন্ম নিল মুক্তিবাহিনী। বাধ্য হলাে মানুষ জবাব দিতে। তাহারা যে যেখানে পারল শশাষক সরকারের জালেম সেনাদের প্রতিরােধে প্রয়াস পাইল… তাই তাহাদের প্রত্যুত্তর সুসংবদ্ধ ছিল না। পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল না; ক্রমে মাস দুই পরে তাহারা সুপরিকল্পিতভাবে তাহাদের অভিযান চালাইতে থাকে।”
এই মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যে তাহের সাহেব হাদীস শরীফ হতে উল্লেখ করে বলেন: “নিজেদের প্রাণ, ধন মান রক্ষায় যে নিহত হয় তাহার মৃত্যু শহীদের মৃত্যু।
এই কনভেনশনে সভাপতি হিসেবে আজাদ হিন্দ বাহিনীর জেনারেল শাহ নওয়াজ খাঁ, সারা ভারত জমিয়তে উলামার সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য মওলানা সৈয়দ আসাদ মাদানী প্রভৃতিও একটি ঐশ্লামিক রাষ্ট্রের স্বরূপ নিয়ে যেমন বলেছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংগ্রামী জন সাধারণকেও। জানান। আর সকলেই তাহের সাহেবের-“আমেরিকা, চীন প্রভৃতির নিজ স্বার্থে জালিম ইয়াহিয়া খান ও তার সরকারের সাহায্য যদি দোষের না হয় তবে নির্যাতিত মজলুম বাংলা দেশবাসীর সাহায্য সহায়তায় হিন্দুস্থানের অপরাধ কী?” উক্তির সমর্থনে নিজেদের কথাও বলেন।
শেষত :, এই কনভেনশন প্রস্তাব গ্রহণ করে| (১) নিঃশর্ত সমর্থন জানায় বাংলাদেশের সংগ্রামকে; (২) ঘৃণা প্রকাশ করে ইসলামাবাদ-চক্রের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিকে; (৩) দাবী করে মুজিবের মুক্তি এবং ঐ সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন করে ইসলামাবাদ-সামরিক চক্রের বিচার; এবং (৪) আশা প্রকাশ করে যে ভারত সরকার সময়মতাে স্বীকৃতি দেবে প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশকে।
সূত্র: কম্পাস, ২৮শে আগস্ট ১৯৭১