You dont have javascript enabled! Please enable it!

আর্থিক পঙ্কে নিমজ্জমান পাকিস্তান

বিশ্ব সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলাের খবর অনুসারে পাকিস্তানের মুদ্রামূল্য হ্রাসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে নিশ্চিতরূপে। এমন কি পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলাে, যেগুলােকে সরকারের মুখপত্র বলেই ধরা হয়, যেমন, পাকিস্তান টাইমস পত্রিকা স্বীকার করেছে যে পাকিস্তান সাহায্য সংঘ এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক মুদ্রামূল্য যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস করার জন্য ইসলামাবাদকে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। এরকম সংবাদ দেওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার কোনাে স্পষ্ট বিবৃতি দেয়নি। এ ঘটনা গত বছরের জুলাই ডিসেম্বর মাসের দুটি ঘটনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই সময়ে লন্ডন ও ওয়াশিংটনের সংবাদ পত্রগুলােতে পাকিস্তান তার মুদ্রামূল্য হ্রাস করবে এই মর্মে খবর বেরােলে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ জানানাে হয়েছিল।
তাই সরকার পক্ষের নীরবতা এটাই দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত করে যে, পাকিস্তান এক চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। পূর্ববাংলার জন্য অধিক পরিমাণ সাহায্য মঞ্জুর না করলে এবং সামরিক যুদ্ধের ব্যয় না কমালে পাকিস্তান সাহায্য সংঘ যে সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছে, এ কথাটা পাকিস্তানের প্রচার দপ্তরও অস্বীকার করেনি। অন্তত ছয় মাস ঋণ শােধ স্থগিত রাখা সম্বন্ধে ইসলামাবাদের অনুরােধের ব্যাপারে ঋণ দাতারা এখনও মনস্থির করতে পারেননি। এ বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা ধার শােধ করার কথা আছে পাকিস্তানের। যদি ইসলামাবাদ মুদ্রামূল্য হ্রাস করবে বলে স্থির করে, তাহলে এই ঋণের পরিমাণও সেই অনুপাতে বেড়ে যাবে। পাকিস্তান তার মুদ্রামূল্য শতকরা প্রায় একশ ভাগ হ্রাস করবে। এর অর্থ পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ, যা এখন দাঁড়িয়েছে ৪৫০০ কোটি টাকায় বেড়ে যাবে দ্বিগুণ।
পাকিস্তান যে কি পরিমাণ আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছে তা বােঝা যাবে বাংলাদেশে উৰ্দ্ধগতি খরচের বােঝা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুসারে। লন্ডনের ইনস্টিটিউট অফ্ স্ট্যাটেজিক স্টাডিজ এর একজন বিশেষজ্ঞের মত অনুযায়ী পূর্ববাংলায় প্রতিদিনের যুদ্ধের খরচ ১ কোটি টাকা থেকে লাফিয়ে ১.৫০ কোটি টাকায় উঠে গেছে। খরচের এই আশ্চর্যজনক উৰ্দ্ধগতির কারণ হচ্ছে যে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে পাকিস্তান তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে দ্বিগুণ। জানা গেছে পাঁচ ডিভিশনেরও বেশি সৈন্য আছে এখন বাংলাদেশে। সৈন্য রক্ষণাবেক্ষণ পরিবহন, তেল, গােলাগুলি প্রভৃতি ব্যাপারে খরচ ছাড়াও বিমান যােগাযােগের জন্য পাকিস্তানকে যথেষ্ট পরিমাণে খরচ করতে হচ্ছে।
চীনের সাহায্যে কিছু খরচ কমিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নিজের স্বার্থেই চীন পাকিস্তানি সৈন্যদের অস্ত্র সাহায্য এবং বিমান সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে বেশ উদার মনােভাব দেখিয়ে আসছে। তথাপিও পাকিস্তানকে অনেকগুলাে ব্যাপারের জন্য, যেমন তেলের জন্য বেশ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে কারণ তেল আমদানি করতে হয় পশ্চিমা দেশগুলাের কাছ থেকে। আকাশে এবং মাটিতে দু দিক থেকে পরিবহনের জন্য তেল খরচ হচ্ছে দৈনিক বিশ লক্ষ টাকার।
অর্থনীতি বিপর্যস্ত করে যুদ্ধের খরচ যতই বাড়ছে অসন্তোষ তত বেশি বেড়ে চলেছে খােদ পাকিস্তানে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সাথে সাথে সিন্ধ অঞ্চলে অসন্তোষের কালাে মেঘ ঘনিয়ে আসছে।
জি.এম্ এস, সৈয়দ, বিখ্যাত কবি শেখ আয়াজ এবং সিন্ধ প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য মালিক গােলাম জিলানিকে কারগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানকে সমর্থনের জন্যই জি. এম. সৈয়দকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সিন্ধু জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের জন্যও সৈয়দকে দায়ী করা হয়েছে। সরকারি মুখপত্র হিসাবে পরিচিত জং এবং “হুরিয়াত” পত্রিকা অভিযােগ করেছেন যে, বাংলাদেশের সগ্রামের অনুসরণে “জয় সিন্ধ” আন্দোলন দিনে দিনে দানা বেঁধে উঠেছে। “জং” প্রথম পৃষ্ঠায় বড় খবর দিয়ে জানিয়েছেন, সিনধি ছাত্ররা পরস্পরকে “জয় সিন্ধ” বলে সম্বােধন শুরু করে দিয়েছেন। করাচি, হায়দ্রাবাদ, সিন্ধ এবং মিরপুর খাসে “জঙ্গী শাসকদের সিন্ধ দেশে উৎপীড়ন” বর্ণনা করে পােস্টার পড়েছে। লন্ডনের খবরে প্রকাশ, ব্রিটেন নিবাসী এক বিরাট সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছেন।
সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত পশ্চিম পাকিস্তানি ছাত্র, শিক্ষক এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের এক সভায় “বাংলাদেশের সাথে সংহতি সাধক পশ্চিম পাকিস্তান সংস্থা” গঠন করার কথা স্থির হয়েছে।
বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন বিখ্যাত ছাত্র নেতা তারিক আলি, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার এয়ার কমডাের জানজুয়া, বিখ্যাত লেখক ও পণ্ডিত হামজা আলভি এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতা নাসিম বাজোয়া।
কেশবচন্দ্র শূর

২৯ মে, ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!