You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.04 | রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবেনা দিন (৯) | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

পশ্চিমবাংলা
রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবেনা দিন (৯)
কল্যাণী উদ্বাস্তু শিবিরে কয়েকদিন

পরের দিন সেই বড় ছাউনির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। কয়েকজন মানুষ শুধু ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘেঁড়া পাতার মতাে। চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
আধ ময়লা থানপরা এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন সামনে, “আপনাকে খুঁজতেছিলাম। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলাে। তাঁর নাম অন্নপূর্ণা কুণ্ডু। ফরিদপুরের মথুরাপুর গ্রাম থেকে এসেছেন ভাসুর পরিবারের সঙ্গে, শ্বশুর ও এক দেবর মারা গেছেন মিলিটারির গুলিতে। উনি কাজ করতে চান, সেলাই, নার্সিং দুটোরই ট্রেনিং নেওয়া আছে। তথ্যগুলাে টুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলাম “মিলিটারি অত্যাচার করছিল গ্রামে?” “জ্বালাইয়া পুড়াইয়া ছারখার করছে। কোনােক্রমে এক বস্ত্রে পলাইছি।” “মুক্তিফৌজ তাে প্রাণপণ লড়াই করতেছে। ধরেন এই দেশে একটা কাজ পাইলেন। তখন কী ভাবে তাদের সাহায্য করবেন?” “শুধু খাওয়া পরা পাইলেই তাদের সেবা শুশ্রুষার কাজে লাগমু। এই কাজে টাকার প্রশ্ন নাই।” “এছাড়া।” “তাগাে তাে ইউনিফর্মের দরকার। সিলাই করা দিমু।” আপনার কথা লেখ্যা নিলাম। কোনাে খবর পাইলে জানাইমু।”
আবার এগিয়ে গেলাম ছাউনি সমুদ্রের ভিতরকার দিকে। আজ বিকেলে কলকাতায় ফিরব আমি, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় আছে হাতে। এখন আমি পরিচিত হয়ে গিয়েছি ওদের কাছে। সবাই ডাকাডাকি করতে লাগলেন। একটা জায়গা বেছে জড়াে করা কিছু কুটোকাটার উপর বসলাম। ঘিরে ধরছেন সবাই।
“কার কথা শুনবেন আগে?” -“একে একে সকলে কইন। আপনে কইন।” যিনি সবচেয়ে বয়স্ক তার দিকে তাকালাম। তিনি এগিয়ে বসলেন। নাম হিরণ্য কুমার সরকার, মিলিটারির গুলিতে তাঁর আত্মীয় পরিজনের মধ্যে আটজন মারা গেছেন আরাে পাঁচজন আহত। যশােরের শ্রীপুর গ্রাম থেকে এসেছেন তারা। মিলিটারি ছাড়া স্থানীয় লােক উৎপাত করছে?” “স্থানীয়? হ্যা মুসলিম লীগের গুণ্ডারা লুটপাট করছে।” “আপনারা তাে আওয়ামী লীগরে ভােট দিছলা।” “সকলেই তাই। মুসলিম লীগ তখন একটা ভােটও পাইছে কিনা মনে সন্দ্য হয়।” কিন্তু দাঙ্গার বেলায় তাে তারাই ছারখার করল। লােক বল তাে আপনারার বেশি।” “এইটা ঠিক না মা। আমাদের হাতে যে কেবল লাঙ্গল ছিল। অস্ত্রবল তাে নাই। আর এই গুণ্ডাগুলানের সঙ্গে তাে ষড় করছে ইয়াহিয়া খানের দল। অস্ত্র জুগাইছে তারা। অতর্কিতে আক্রমণে আমাদের মরণ আর পলায়ন ভিন্ন উপায় ছিল না। অস্ত্র থাকলে রুখতাম।” “মুক্তিফৌজ মিলিটারী ট্রেনিং দিলে নিবা?” “নিব। তাগাে কাজে যােগ দিব।” “বাংলাদেশ স্বাধীন হইলে ফিরবা?” “নিশ্চয়। জিগাস করেন। সকলেই ফিরব।” “অনেকে শুনছি ফিরতে চায় না।” “কারা? ভদ্দর লােকেরা? মা আমরা চাষিবাসী। মাটি ছাড়া অন্য কিছু জানি না। প্রাণের দায়ে আসতে হইছে কইয়া কি দেশের প্রতি কর্তব্য নাই? মাতৃভূমি তাে সেইটাই।” “হ্যা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরব, মুসলিম রাষ্ট্রে না।” মুখ ফিরিয়ে তাকালাম, এক দৃঢ়দেহ ব্যক্তি একটু এগিয়ে বসলেন-“কী নাম আপনার?” “সুরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ফরিদপুরের জঙ্গিগ্রামে আমার চার বিঘা জমি, দশটা আমগাছ, দুইটা কাঁঠাল গাছ, চারটা নারিকেল গাছ। শুখনাে হাসতাছেন নাকি মনে মনে? যা আছে তাই কইলাম, বাড়াইয়া কইলে মাটির অপমান।” “হাসতেছি কই? আমার তাে বিঘাটাক জমিও নাই।” “সম্পদ তােমার উপছাইয়া পড়ব মা।” “কেমনে কইন,” লিখতে লিখতে হাসলাম-“এই যে কাছে বইসা আমাদের কথা শুনতাম। প্রাণ র্যা আর্শিবাদ করতাছি। দেশ স্বাধীন হইলে আমাদের গ্রামে যাইও।” “স্বাধীন বাংলাদেশে তােমাদের ভয়ডরের কোনাে কারণ নেই।” “জয়বাংলারে মােরা ক্ষয়বাংলা হইতে দিব না।” সচকিত হয়ে তাকালাম। এক বলিষ্ঠ দেহ তরুণ এসে বসেছেন একপাশে। “ক্ষয়বাংলা কেউ কইতেছে নি?” “না, কওনের কি। এইটা করনের উদ্দেশ্য।” “কী নাম আপনার?” “নিতাই বিশ্বাস। ফরিদপুরের কোলানগরে আমার নিজের বাড়িঘর, দোকানপাট, আম কাঁঠাল গাছ, বাঁশঝাড়, খামারে বছরের ধানচাল মজুত ছিল।” “মুক্তিফৌজে যােগ দেবেন।” “কোনখানে রিক্রটিং হইতেছে” নিতাই বিশ্বাস সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন। “আমি তাে জানি না। তবে আপনাদের দেশের ব্যাপার। ক্রমে ক্রমে জানবেন।” “এমনভাবে কইলেন যেমন এ শুধু আমাদেরই ব্যাপার। আমরা সাধ করা এই দেশে মাগতে আসছি।” আমি লজ্জিত হলাম, সংবাদপত্রের “আভ্যন্তরীণ সমস্যা” মগজে ঢুকে গেছে বললাম “ভুল বুঝবেন না। সেই কথা না। সৈন্যদল আপনাদের, সেই সৈন্যদলে যােগ দিতে চান জানলে তারাই যােগাযােগ করবেন”। “কিন্তু জানাইতে তাে হইব, যে আমরা আছি।” “সেই জন্যই তাে লেখতাছি।” “আহা মা লেখ। পরীক্ষায় বসলে যেন জলপানি পাও।” “আগে তাে আপনাদের জলপানি দেই মুখে।” “এতাে মানুষরে বসাইয়া খাওয়াইতে গেলে অন্নপূর্ণার ভাণ্ডারও শূন্য হয়। এই দেশে ট্রেনিং হয় না মা?” – আমি জবাব না দিয়ে লিখছিলাম, ওঁরা বলে চলেছেন- “ইন্দিরা গান্ধীরে জানাইও।” “শুনছি যুদ্ধ বিগ্রহের কালে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মিত্রতা হয়। তােমাদের দেশ থে আমাদের ট্রেনিং দিব না?” “লােকবল তাে আছে, অস্ত্র ধরতে জানি না। আমি চোখ তুলে তাকালাম-“আমি লিখবাে আপনাদের কথা। কমিয়ে লিখবাে না বাড়িয়েও না। যা বলছেন তাই লিখবাে সেটুকুই আমার কাজ। আমি লিখবাে যে আপনাদের জয়বাংলাকে আপনারা ‘ক্ষয়বাংলা’ হতে দেবেন না কিছুতেই।
রুচিরা শ্যাম

সূত্র: কম্পাস, ০৪.০৯.১৯৭১