You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৬ই আগস্ট, সোমবার, ১৯৭৩, ২১শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শান্তির পথে অগ্রাভিযান

কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে গত শুক্রবার ৬৩ সালের আংশিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তির নীতিসমূহ অনুমোদন করে সংশ্লিষ্ট সকল জাতিকে সবরকম আণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণের জন্যে একটা নতুন চুক্তি সম্পাদনের আহ্বান জানিয়েছে। যদিও ঘোষণায় চীন অথবা ফ্রান্সের নাম উল্লেখ করা হয়নি তবুও এ দু’টো দেশের সাম্প্রতিক আণবিক পরীক্ষা চালানোর প্রেক্ষিতে কমনওয়েলথের এই আহ্বান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ আরো এই কারণে যে, এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়েছে এবং বৃটেন সহ ফ্রান্সের বন্ধুরাষ্ট্র সমূহ উচ্চবাচ্য করবার কোন সুযোগ লাভ করেনি। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, সম্মেলনের ঘোষণায় ফ্রান্সের কোন প্রকার সমালোচনা থাকলে বৃটেন তার বিরোধিতা করবে। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত ঘোষণা স্বাক্ষরিত হবে।
অটোয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলনে যখন যোগদানকারী প্রতিনিধিরা আণবিক পরীক্ষার বিরুদ্ধে সোচ্চার তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী মানুষের স্বপক্ষে আর একটি সংবাদ ঘোষিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি মিঃ উইলিয়াম ডগলাস পনেরোই আগস্ট থেকে কম্বোডিয়ায় মার্কিন বোমাবর্ষণে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। বস্তুতঃ যুক্তরাষ্ট্রের একটি জেলা আদালত গত মাসে কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণ মার্কিন সংবিধানের পরিপন্থী বলে যে রায় দিয়েছিলেন এটা সে রায়কেই বলবৎ করবার নির্দেশ বিশেষ। সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ ঘোষিত হবার পর মুহূর্ত থেকেই তা কার্যকরী হবার কথা। প্রেসিডেন্ট নিক্সন সিনেট কমিটির কাছে প্রেরিত এক পত্রে সুপ্রীম কোর্টের এই নির্দেশ মেনে চলা হবে সুপ্রীম কোর্টের এই নির্দেশ মেনে চলা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। অবশ্য একই সঙ্গে তিনি বলেন যে, বোমাবর্ষণ বন্ধের ফলে নাকি ইন্দোচীনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হবে।
দু’টি ঘোষণাকেই আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। এ দু’টো ব্যবস্থা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের নীতির সমর্থক। এবারের কমনওয়েলথ সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আণবিক পরীক্ষা এবং কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে সবচাইতে সোচ্চার এবং সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছিলেন। আমরা সম্পূর্ণভাবে আণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণের পক্ষপাতি। কমনওয়েলথ সম্মেলনের এই ঘোষণা স্বাক্ষরিত হবার পর সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ কি ভূমিকা গ্রহণ করেন তা আগ্রহের সাথে আমরা লক্ষ্য করবো। একটা কথা অত্যন্ত সত্য যে শুধুমাত্র প্রস্তাব পাশের দ্বারা এতবড় একটা সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। তবে এই অমানবিক এবং ‍যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ সম্মেলনের মন্ডপ থেকে উচ্চারিত হলো তা শান্তিকামী মানুষের অগ্রাভিযানে প্রেরণা যোগাবে, মূল লক্ষ্য অর্জনের দুর্গম পথে অগ্রসর হবার শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
আমরা মনে করি না যে, কোন অলৌকিক উপায়ে রাতারাতি গোটা দুনিয়া থেকে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, যুদ্ধংদেহী মনোভাব তথা প্রতিক্রিয়ার সকল শক্তি হাত গুটিয়ে নেবে। তবে শান্তিকামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ এবং অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে যে একদিন শান্তির চরম লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে এ বিশ্বাস আমাদের আছে। সেই বিশ্বাসকে সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথ সম্মেলনে আণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ এবং কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণ বন্ধের দাবী জানিয়েছিলেন; আজ সেই সম্মেলন মন্ডপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টে তার সেই আহ্বানের স্বীকৃতিতে আমরা সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই অভিনন্দন জানাই। শান্তির পথে বিশ্ব মানুষের অগ্রযাত্রাকে জানাই আমরা সশ্রদ্ধ মোবারকবাদ।

টিসিবির তোঘলকী কান্ড

‘কোম্পানী কা মাল দরিয়া মে ডাল’ বলে যে বহুল প্রচলিত প্রবচনটি রয়েছে, ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হচ্ছে, টিসিবি এই নীতিটিই অনুসরণ করে চলেছে। নইলে ছ’মাসের জন্যে বাংলাদেশ বাণিজ্য সংস্থাকে (টিসিবি) চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের কাছে ডেমারেজ হিসেবে এক কোটি আট লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা কড়ায় গন্ডায় গচ্চা দিতে হবে কেন? টিসিবি বিদেশ থেকে আমদানীকৃত মালামাল বন্দর থেকে ছাড়িয়ে নিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমদানীকৃত মালামালের মধ্যে ঢেউটিন এবং বনস্পতি ঘি রয়েছে। বাণিজ্য সংস্থা সূত্রে একটি বার্তা প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে যে, আমদানীকৃত পঁচিশ হাজার দু’শ’ বাহাত্তর টন বিভিন্ন ধরনের মালামাল এখনো রোদ-বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যে বন্দরে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বাণিজ্য সংস্থা সূত্রে এই সব মালামাল ছাড়িয়ে না নেওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে, পরিবহনের অপ্রতুলতার জন্যেই নাকি বন্দর থেকে এই মালগুলো ছাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এবং সম্ভব হচ্ছে না বলেই টিসিবিকে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে খেসারত দিতে হচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, টিসিবির এই ডেমারেজের ব্যয় খদ্দেরদেরই ঘাড়ে পড়বে। কারণ মালের দাম ঠিক করার সময় ডেমারেজ বাবদ ব্যয়কে মালের ভাড়ার মধ্যে ধরে দেওয়া হবে। বন্দর ডেমারেজ কিংবা যেভাবেই টিসিবিকে আর্থিক গচ্চা দিতে হোক না কেন, সেই গচ্চার বোঝা তো ক্রেতা সাধারণরাই বহন করবেন, অতএব, এতে বাংলাদেশ বাণিজ্য সংস্থার (টিসিবি) অতোশত ভাবনার কারণ কি?
বলা বাহুল্য মাত্র যে, টিসিবি আমদানীকৃত অধিকাংশ জিনিসপত্রেরই দাম অত্যন্ত চড়া—যা ক্রেতাসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের বাইরে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর টিসিবি যখনই যা কিছু বিদেশ থেকে আমদানী করেছে, তখনই এ ধরনের একটা না একটা তোঘলকী কান্ড সংঘটিত হয়েছে। টিসিবি কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতার জন্যে যে গত ছ’মাসের জন্যে প্রায় দেড় কোটি টাকা চট্টগ্রাম বন্দরকে ডেমারেজ দিতে হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিদেশ থেকে আমদানী করা মাল টিসিবি কর্তৃপক্ষ কেন সময়মতো বন্দর থেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হলো আর সেই ব্যর্থতার বোঝা কেনই বা ক্রেতাসাধারণকে বহন করতে হবে, তা কি টিসিবি কর্তৃপক্ষ একবার ভেবে-চিন্তে দেখেছেন? জানিনা, টিসিবি কর্তৃপক্ষ পরিবহনের অপ্রতুলতার দোহাই দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে হালকা করতে চাচ্ছেন কি না। তবে পরিবহনের ক্ষেত্রে যে নানা প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে, তা আমাদের অজানা নেই। সব কিছুই জানা সত্ত্বেও টিসিবি কর্তৃপক্ষ বন্দর থেকে মালামাল ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কেন ঔদাসীন্য দেখালো, আর কেনই বা ডেমারেজের অর্থ পরিশোধ করলো তা আমাদের গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। টিসিবি যদি ক্রমাগত এই ধরনের তোঘলকী কান্ডকারখানাই অব্যাহত রাখে, তাহলে আমরা মনে করবো, টিসিবি তার দায়িত্ব পালনে শেষাবধি ব্যর্থতাকেই আলিঙ্গন করে নিচ্ছে। ক্রেতাসাধারণের গলাকাটা নীতি টিসিবি কি বর্জন করতে উদ্যোগী হবে না?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!