আকর্ষণ বিকর্ষণের কলকাতা
অমর রাহা
আকর্ষণ বিকর্ষণের কলকাতা। এ সম্পর্কে একটা কাব্য ছিল, আর এই শহরকে জানবার ও বুঝবার আগ্রহও ছিল প্রবল। দেশ বিদেশ হতে মানুষ আসতে চাইত এই শহরে এবং এই মুখর কলকাতাকে দেখে ভালােবেসেছে। এমনি ভালবেসেছে সােভিয়েত ইউনিয়নের সকলেই সেদিন যেদিন খু-বুলগানিন এসেছিলেন এই শহরে। আবার যে নেহেরু কলকাতাকে শােভাযাত্রার কলকাতা বলে অভিযুক্ত করতেন সেই নেহেরুও বারবার যেমন আসতে চাইতেন এই শহরে ঠিক তেমনি এই শহরও ভেঙে পড়ত ঐ নেহেরুকে দেখবার জন্য।…
কলকাতা ছিল অভিমানী, ছিল মুখর এবং ছিল সজীব চির তারুণ্য নিয়ে। কিন্তু আজ?
জঘন্য কলিকাতা
আজ সুন্দরী কলকাতা নানা দুরারােগ্য ব্যাধিগ্রস্ত। রং-বেরং এর পােশাক-আসাকে নিজের ব্যাধি ঢাকবার ক্ষীণ প্রচেষ্টাও আছে। কিন্তু যে কবিরাজ বা ডাক্তার এর তদারকি করছে সে বা তাঁরা হলেন ভলতেয়ারের ডক্টর প্যাংলস্ গােত্রীয়। অতএব, লজ্জা বলে কিছুই নেই।
নিলাজ শহর আজ তাই রাজনীতি ও সমাজনীতির ক্ষেত্রে হত্যা করার পদ্ধতি এবং স্থানীয় স্বার্থে বন্ধ করার নীতিকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই দেখা যায় বারাসত সলট লেক-দমদম জেল ঘটনাগুলাের জন্য কোনাে প্রতিবাদ বা বন্ধ ঘােষণা করা হলাে না। অথচ হঁাড়ারামপুরের গাড়ারাম কর্মী মরলে বন্ধ শােভাযাত্রা ইত্যাদি হয়ে থাকে।
আবার যারা শিল্পী, লেখক ও সংস্কৃতিবান সুধীজন [ কবি কালিদাসের চোখে নয়] তারা এসব ঘটনার জন্য এতটুকু চিন্তিত বলে মনে হয় না যদিও বিশ্বশান্তির বাণী, শান্তি পূর্ণ আলাপ আলােচনার মাধ্যম, বিতর্কমূলক সমস্যা সমাধান করার পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে বেশ “সারগর্ভ (?) কথাবার্তা প্রয়ােজনে বলে থাকেন। অর্থাৎ কোথাও কখনও যদি ডেলিগেশান পাঠানাের প্রয়ােজন থাকে, তখনই ঐসব করা হয়। এই ত সেদিনের কথা। বেশ পরিচিত ব্যক্তি। বাংলাদেশ সম্বন্ধে কোনাে খবরই রাখেননি, অথচ হয় বনগাঁ বা দু’এক জায়গায় শরণার্থী শিবির দেখে বিদেশে গেলেন বাংলাদেশের খবরাখবর জানাতে। শুনেছি ভাড়া করা মােরনার পাওয়া যায়, কিন্তু ভাড়া করা সহানুভূতিশীল ব্যক্তি পাওয়া যায় কিনা তা জানা হলাে এবার বাংলাদেশের সংগ্রাম কলাণে।
এরা বা ওঁরাই ১৯৬৭ সাল হতে [বিশেষ করে] লুকোচুরি খেলছেন ইতিহাসের সঙ্গে। আর লুকোচুরির খেলাই আজ এই শহরকে করেছে দুরারােগ্য ব্যাধিগ্রস্ত।
এমনি পরিবেশে
একদিন এলেন মেকং নদীকূল হতে সংগ্রামীদের প্রতিনিধিবৃন্দ। সেদিন দমদম বিমান বন্দরে হাজার দুয়েকের বেশি জনতা দেখা যায়নি অভ্যর্থনা জানাবার জন্য, আর যশাের রােড, শহরের আসার রাস্তায় দেখা যায়নি হাজার হাজার যুবছাত্ৰকুলকে। অথচ, এই শহরে শােনা গেছে তােমার নাম, আমার নাম ভিয়েতনাম” এবং এই পশ্চিমবঙ্গে সেদিন যুক্তফ্রন্ট সরকার।
এমনি পরিবেশে ১৯৬৯ সালের শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য শহীদদের আত্মত্যাগ নিয়ে দেখা গেল না কোনাে আলােড়ন। অথচ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৬৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি মিলে যা হলাে, তা হলাে আজকের বাংলাদেশ।
অথচ, যখন শেখসাহেব ইয়াহিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনা করছিলেন তখনও গভীর মনােযােগের সঙ্গে নির্বাচনে ইন্দিরা নেতৃত্বের জয় সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হয়ে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথাবার্তাও যেমন করেছেন, ঠিক তেমনি অনুধাবন করতেও বলেছেন।…
ওঁরা ও আমরা
ওঁরা আজ সগ্রামে লিপ্ত। ওঁদের ইতিহাসে কি স্থান হবে তা ইতিহাস বলবে। আমাদের বলার স্থান এখানে নেই।
কিন্তু, আমরা? আমরা এমন একটি অভূতপূর্ব সগ্রামের পূর্বে বুঝতে পারিনি। অথচ ধর্ম ও দ্বিজাতি তত্ত্বের মধ্যে জন্ম হল যে রাজ্যের, সেই রাজ্য আজ বাংলাদেশ নামে পরিচিত বিশ্বের কাছে। ওঁরা দীর্ঘ সগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের শুচি করে নিয়ে আজ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে চরিত্র প্রকাশ করেছেন তা বিশ্বের যে কোনাে লােকের প্রশংসা পাওয়ার যােগ্য। অথচ, আমরা ওঁদের সংগ্রামের মর্মার্থ বুঝতে অক্ষম হয়ে পঙ্গু ও অন্ধের মতাে এধার-ওধার করছি।
ওঁরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে বাস্তবে দেখিয়েছেন যে সমাজ জীবনে ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মের স্থান নেই, এবং তাই মুসলিম লীগের কবর হলাে গত নির্বাচনে। আর এখন মুসলিম লীগ হলাে ইয়াহিয়ার দোসর। অথচ এখানে আমরা ইসলামধর্ম বিশ্বাসীদের ভােট পাওয়ার জন্য যা করেছি বা করে থাকি তা প্রশংসনীয় কিনা তার বিচার নিজেদের করাই ভালাে। শুধু ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসী কেন? আদিবাসী ও অন্যান্য সংবিধান সংরক্ষিত গােষ্ঠির বেলায়ও একই পথ বােধ হয় নিয়ে থাকি।
তাই আজ কলকাতা শহরে তেমন কোনাে কার্যক্রম চোখে পড়ে না, আর উৎসাহ-উদ্দীপনায় যেন ভাঁটা পড়েছে। যদিও এঁদেরই সম্বন্ধে খুসাতভ হব লিখেছেন The struggle being waged now by the followers of the Awami League and Bengali people, and even more so the struggle they will conduct in the future, is one for greater freedom of self-determination and greater rights. 478 এর কয়েক লাইন আগে ভ্রাহব লিখেছেন : Once a nation has been awakened and the Bengalis have a rich history and tradition, it is difficult to stop it by force of arms. [Review of International Affairs Belgrade, April 5, 1971]
অথচ
আমরা আজ শেখ মুজিবের নেতৃত্বের সঙ্গে এ-বা-ও ব্যক্তির স্থান করে নিতে চাইছি নানা অজুহাতে। যুক্তি হচ্ছে সন্ত্রামকে শক্তিশালী করা প্রয়ােজন।
সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে হলে সগ্রামীদের সঙ্গে থেকেই তা সম্ভব। এই সঙ্গে থাকার ব্যাপারে বাধা কেউই নিশ্চয়ই দেয় না বা দিতে পারে না। তাছাড়া, শেখ নেতৃত্ব চেয়েছে স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ এবং যে বাংলাদেশের মূল উদ্দেশ্য হলাে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। অতএব এ ক্ষেত্রে কারুর হয়ে ওকালতি করার চেষ্টা নিশ্চয়ই সুখের নয়।
আর সংগ্রাম পরিচালনার ব্যাপারে নবপথের ইঙ্গিত দূরে বসে কেউ দিতে সক্ষম কিনা তাও বিচার্য বিষয়। অথচ, তবুও চতুর-আমরা বলি: কিন্তু…।
– তাই বলি, এই কলকাতার মৃত্যু যেমন কাম্য, ঠিক তেমনি এই আমাদের মুছে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত।
সূত্র: কম্পাস, ১২ই জুন ১৯৭১