You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.03 | পদ্মা-মেঘনা, গঙ্গা-রূপনারায়ণ- অমর রাহা | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

পদ্মা-মেঘনা, গঙ্গা-রূপনারায়ণ
অমর রাহা

এখন কলকাতা শহরের চেহারা স্বাভাবিক বললে অন্যায় হবে না। নকশালী সংবাদ যেমন নেই, ঠিক তেমনি নেই শরিকী সংঘর্ষের সংবাদ।
অথচ, এই কলকাতা চঞ্চল হয়ে উঠল মুজিব নেতৃত্বের সংবাদে। পদ্মা-মেঘনা-ধরলা প্রবাহিত অঞ্চল সষ্টি করল উৎকণ্ঠা ও আনন্দ মিশ্রিত পরিবেশ, সাড়া জাগাল গঙ্গা-রূপনারায়ণকুলের জনজীবনে। এতে নেই ভাবােচ্ছাস, আছে জানবার ও বুঝবার আগ্রহ।
তাই ইয়াহিয়ার ঘােষণার পর ছাত্রযুবক সম্প্রদায় বাংলাদেশের নব সগ্রামের সমর্থনে জানাল নিজেদের সমর্থন। এ ঘটনা ঘটল দিনের আলােয়। আর সন্ধের আঁধারের সঙ্গে সঙ্গে মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল কট্টর জঙ্গী ও বাংলা-বিরােধী টিক্কা খার নিহত (?) হওয়ার সংবাদে।
রাতের আঁধারে লােকের মুখে সুযােগ ও মহান দায়িত্ব বলে গ্রহণ করা উচিত। তাছাড়া আজ পশ্চিম বাংলায় যে বহুদলকন্টকিত আত্মক্ষয়ী সংগ্রাম চলেছে- অন্ধসংগ্রাম চলেছে, তার থেকে নিজেদের মুক্ত করার সুযোেগও একটা উপস্থিত। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সগ্রামকে সাহায্য করার জন্য আজ যদি পশ্চিম-বাংলার সবদল একতাবদ্ধ কর্মপদ্ধতি নিতে পারে, তবে পশ্চিমবাংলার সগ্রামী মানুষের কাছেও একটা নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত হবে। তখন আমরাও বুঝতে পারবাে যে সূর্য আবার পূর্ব দিক থেকেই উদিত হচ্ছে, এই নতুন সূর্যকে সাদরে অভিনন্দন ও গ্রহণ করার মধ্যে আমাদেরই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
দেখা গেল এক নতুন হাসি-আশার হাসি। পাক রেডিওর কোনাে সংবাদই বিশ্বাস করতে চাইল না এই মানুষগুলাে। দাঁড়াল দোকানের সামনে শুনতে এখানকার রেডিওতে ইন্দিরার কথা। এই যাঁরা দাঁড়াল তাদের হাতে কিন্তু সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যা। তবুও শুনতে চাইল…
রেডিও সংবাদ ইন্দিরা বিশ্বাস করে না মুজিব গ্রেপ্তারের সংবাদ।… লােকের ভিড় যেন ক্ষণিকের জন্য হয়ে দাঁড়াল মানুষের ভিড় এবং ক্ষণিকের জন্য পরিবেশে অনুভূত হলাে এক দৃঢ় প্রত্যয়। মনে হলাে, ইন্দিরা এই দৃঢ় প্রত্যয়কেই ভাষা দিয়ে ঘােষণা করলেন ভারতীয় সংসদে।
এই মানুষগুলাে আবার চলে, কারণ যাবে তারা গৃহে। অথচ, চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল এমন এক দৃষ্টি যাকে বুঝতে সময় লাগে। অন্যদিনের মতাে তাড়া নেই, অথচ যেন কিসের তাড়া। হঠাৎ শােনা গেল কথােপকথন: আমরা কেন সৈন্য পাঠাব? তা করলে অবস্থা খারাপ হবে।…আপনি বুঝছেন না…তাছাড়া, দেখুন মুজিব নেতৃত্ব সামরিক শাসনের কি করে…।
এই জনমনই সেদিন ১০ই মার্চ জানাল ইন্দিরা নেতৃত্বের প্রতি আস্থা। ওপারের লােকও জানাল আস্থা মুজিব-ইন্দিরার ছবি পাশাপাশি টাঙ্গিয়ে। দুটি অঞ্চলের মন, অথচ একই চেহারা।
এই মন যেমন হলাে পদ্মা-মেঘনা-ধরলা প্রবাহিত অঞ্চলের সম্পদ, ঠিক তেমনি সম্পদ হলাে গঙ্গারূপনারায়ণকূলে। তবে ওদিকে আজ কোনাে বাধা বা অন্তরায় টিকবে না নব জোয়ারের সামনে।
তবে যদিও এই নাগরিক মন হলাে দেশের সম্পদ, তবু এই পথের অন্তরায় হলাে বিভ্রান্তি আনয়নকারী কথাবার্তা, বা বিশ্লেষণ, বা সমালােচনা।
এমনি ধরনের বিভ্রান্তি বােধহয় সৃষ্টি করে থাকে নিম্নলিখিত জাতীয় বিশ্লেষণ:
“এই নির্বাচনে চরমপন্থী দল-জনসংঘ, সিণ্ডিকেট এবং স্বতন্ত্র, যারা নির্বাচনী দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়েছিল তাদের চরম বিপর্যয় গােচরীভূত হয়েছে।…জনগণ কার্যত একচেটিয়া পুঁজিপতি পরিবারগুলাের সরাসরি প্রতিনিধিদের উৎখাত করেছেন।…
…কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল জোটের বিপর্যয়ে গণতান্ত্রিক শক্তি এবং জনগণ, যারা দারিদ্র এবং বেকারির বিরুদ্ধে সন্ত্রাম করছেন তাঁদের জয় সূচিত হয় না।….
…[তাছাড়া] ইন্দিরা গান্ধী নিজেকে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের সত্যকার একজন স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে হাজির করেছেন আর এস.এস এবং জনসঙ্রে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আক্রমণকে কেন্দ্রীভূত করতে পেরে, যেটা তাঁকে অভূতপূর্ব সাফল্য দান করেছে। উত্তর প্রদেশে সাফল্যের একটা অন্যতম কারণ হলাে জনসঙ্রে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই আক্রমণ কেন্দ্রীভূত হওয়া।
“ইন্দিরা গান্ধী সমাজতন্ত্রের জন্য বাগাড়ম্বর, দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দম্ভোক্তি শুধু দক্ষিণপন্থী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বীদেরই ঘায়েল করতে সক্ষম হয়নি, লােকসভায় গণতান্ত্রিক বিরােধী শক্তিকেও কিয়ৎ পরিমাণে খর্ব এবং ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে।
“ইন্দিরা গান্ধীর জয়কে কোনাে ক্রমেই জনগণের জয়, গণতান্ত্রিক এবং সগ্রামী মানুষের জয় বলে গণ্য করা চলে না।”
এমনি ধরনের চিন্তার প্রতিচ্ছবি দেখা গিয়েছিল বা যায় ঐ বাংলাদেশে, কিন্তু যে বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগরিষ্ঠ করল ব্যালট বাক্স মাধ্যমে সেই জনগণই সেদিন পৃথিবীর ইতিহাসে দেখাল নতুন ধরনের কু-সিভিল কু সামরিক শাসন ও ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে। [মহাত্মা বেঁচে থাকলে স্বীকার করতেন এমনটি তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, আর নেহরু বেঁচে থাকলে একে অভিনন্দন করতেন এমন ভাষায় যা’ এই উপমহাদেশে আনত নব জোয়ার]। আর সেই ভাসানী বা তাঁর সহসঙ্গীরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন মুজিব নেতৃত্বের প্রতি যে নেতৃত্বের কল্যাণে সেদিন দেখা গেল বাংলাদেশের পথে-ঘাটে দুটি ছবি পাশাপাশি মুজিব ও ইন্দিরা যেন দু’ভাই বোেন।

সূত্র: কম্পাস, ৩রা এপ্রিল ১৯৭১