You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.18 | ঢাকায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ-১৬ই ডিসেম্বর | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ-১৬ই ডিসেম্বর

আজ ১৬ই ডিসেম্বর সকাল ১০-৪০ মি. ভারতীয় বাহিনীর একটি দল ঢাকা শহরে প্রবেশ করেছে আর পাক বাহিনীর মে. জে, সমসের তার অধীনস্থ সেনাদলসহ আত্মসমর্পণ করেছেন। ইতিপূর্বে আজ সকাল সাড়ে আটটায় বাংলাদেশে পাক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী ভারতের সর্বাধিনায়ক মানেকশ’র কাছে যুদ্ধ বিরতির জন্য আরও সময় চেয়েছেন বেলা ৩টা পর্যন্ত। পরে খবর আসে পাক-বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে রাজী। ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ণ কমান্ডের মে. জেনারেল জেকব বেলা সাড়ে বারােটায় ঢাকায় পৌঁছেছেন। তিনি লে. জে. নিয়াজীর সঙ্গে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের শর্তাদি নিরূপণের জন্য আলােচনারত। (এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোেগ্য, লে. জেনারেল নিয়াজী ১৫ই ডিসেম্বর বেলা ২-৩০ টায় ভারতীয় বাহিনীর সদর দপ্তরে নয়া দিল্লীস্থ মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ভারতীয় স্থলবাহিনীর সর্বাধিনায়ক মানেকশ’ ঐ প্রস্তাবে সায় দিয়ে ঐ দিনই বিকেল ৫টা থেকে পরদিন ১৬ই ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা শহরে বিমান আক্রমণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে লে. জে. নিয়াজীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন।

রণতরীর রাজনীতি

মহাশয়,
মঙ্গলবার ১৪ই ডিসেম্বর দৈনিক পত্রিকায় একটি খবর বেরিয়েছে আমেরিকার একটি পারমাণবিক শক্তি চালিত যুদ্ধ জাহাজ তার লট বহর নিয়ে ভারত মহাসাগর অভিমুখে যাত্রা করেছে- লক্ষ্যস্থল বঙ্গোপসাগর। প্রকাশ্য বক্তব্য নাকি ঢাকায় আটক_পড়া ১৭ জন মার্কিন নাগরিকের উদ্ধার সাধন। ঢাকা থেকে অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকেরা চলে এসেছেন কিন্তু এই মার্কিন বাসিন্দারা আসেননি বােধহয় তাদের দেশের রণতরী বহরের আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন।
ভারত সরকার মনে করছেন এটা একটা মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টির কৌশল মাত্র, যাতে ভারত ইউ,এন,ও,র যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়। সেই পুরােনাে গানবােট পলিসি।’
ঐদিন আরও একটি খবর বেরিয়েছে। চীনা সামরিক বাহিনী ও ভারতের উত্তর সীমান্তে সৈন্য চলাচল করছে এবং একটি হুমকিও দিয়েছে ভারতকে হয় যুদ্ধ বন্ধ কর নয়ত পরাজয় বরণ করতে হবে। তাহলে চীনও কি লড়াইতে নেমে পড়বে। পানিস্তানের এই দুই দোস্ত একই সময়ে একই সুরে হুমকি দিচ্ছে এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। চীন এর আগে একমাত্র কোরিয়ার যুদ্ধে যােগ দিয়েছিল। বিদেশি রাষ্ট্রে গিয়ে তার লড়াই সেই প্রথম। তারপর ভারত ভূখণ্ডে একবার মাত্র ঢুকে পড়েই সে আবার পেছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর যখন ভিয়েনামে মার্কিন সরকার অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তখন থেকে চীন বলে আসছে যে সে ভিয়েনামকে সমর্থন করে যাবে কিন্তু সেখানে তার সৈন্য পাঠাবে না কারণ সে অন্য রাজ্যে নিজ সৈন্য পাঠিয়ে সহায়তা দানের বিরােধী। অথব এখন সে যদি পাকিস্তানকে রক্ষাকল্পে ভারত আক্রমণ করে তাহলে কি একথাই প্রমাণিত হয় না যে চীন ভিয়েনামে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করেনি পাছে মার্কিন সরকারের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়তে হয়। আর আজকে তার মার্কিনের সঙ্গে মিতালীও কি সেই মার্কিন ভীতি সজ্ঞাত নয়?
অদ্ভুত এক রাজনৈতিক মিতালী সংগঠিত হয়েছে গণতন্ত্রবাদী ধনতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধর্মোন্মাদ সামরিক ফ্যাসীবাদী পাকিস্তান ও গণপ্রজাতন্ত্রী কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীন। এখন একথা বললে বােধহয় অসমীচীন হবে না যে এই তিনটির যে কোনাে একটিতে ঘা লাগলে সবগুলােতেই সে ঘা বাজবে। এবং সেই রকম একটি চুক্তি নিশ্চয়ই হয়েছে তা না হলে চীনের মতাে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের পক্ষে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে মদদ দেওয়ার কোনাে মার্ক্সীয় যুক্তি পাওয়া যায় না। পাকিস্তানের থেকে ভিয়েত্রম চীনের অতি নিকট আত্মীয় প্রতিবেশী হিসেবে, জাতি হিসেবে ও একই আদর্শ অনুসারী হিসেবে। সেখানে সে যদি তার সেনাবল নিয়ে মার্কিন সরকারের সঙ্গে মােকাবেলায় নামত তাহলে চীনকে এশিয়ার মুক্তিদাতা হিসেবে এশীয়রা মেনে নিত।
কিন্তু চীন সে পথে পা দেয়নি। এখন চীনের প্রধান শত্রু আমেরিকা নয়, সােভিয়েট রাশিয়া। এবং সেই হসেবেই সে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছে। আমেরিকার সঙ্গে সদ্ভাব সেই কারণে। এবং যেহেতু ভারত রাশিয়ার মিত্র অতএব ভারত তার শক্র। এশিয়াতে জনসংখ্যার দিক থেকে বিপুল দুটি জাতি, প্রতিবেশী হওয়ায় আশঙ্কার কারণ দেখা দিচ্ছে বেশি এবং পরস্পর পরস্পরকে ভয়ের চোখে দেখছে এবং দূরের রাষ্ট্রগুলাে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য একজনকে আর এক জনের বিরুদ্ধে ভিড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারত যদি প্রবল হয় তাহলে কী চীনের কিছু অসুবিধা হতে পারে? হয়ত কোনাে ভবিষ্যতে ভারতে কোনাে রণলি উন্মাদ দেখা দিতে পারে এবং সে সম্ভাবনা চীনের দিক থেকেও কম নেই। তাই চীনের কামনা ভারত দুর্বল থাকুক এবং পাকিস্তানের সঙ্গে তার শত্রুতা চিরকাল বজায় থাক। এবং সেইজন্যে পাকিস্তানের প্রয়ােজনে তাকে হয়ত ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হবে। এ যদি হয়, তাহলে এ ঘটনা হবে সমাজতান্ত্রিক জগতের এক অভিনব ঘটনা। একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ একটি ধর্মোন্মাদ ফ্যাসিস্ট মিলিটারী জুন্টাকে সমর্থন দিচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্র তার আদর্শ সমাজতন্ত্র বলে দাবী করে। বিচিত্র এই চীনের কমিউনিজম।
সুবােধ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কলি-৬

সূত্র: কম্পাস, ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১