You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.03 | পূর্ববাংলার জাগরণ ও ইংরাজি সংবাদপত্র | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

ইউরােপের চিঠি
পূর্ববাংলার জাগরণ ও ইংরাজি সংবাদপত্র
নৃপেন্দ্রনাথ ঘোেষ

যে বি-বি-সি, ঐ টাইমস্ এবং ঐ গার্ডিয়ান পত্রিকার নামে বাঙালি হ্যাদাইয়া মরে সেই কয়টি প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনায় নীরব ছিল কিন্তু আজ নহে। গতকাল বৈকালে ঢাকায় গুলি-গালাজ ব্যাপারে প্রথম সংবাদ আসে সুইডিশ বেতার মারফৎ। বিদ্যুৎগতিতে সারা লন্ডনে উহা ছড়াইয়া পড়ে। সংবাদ আহরণ ব্যাপারে এই তিনটা প্রতিষ্ঠানের গােমর ফাঁকে। আজিকার প্রভাতের সংবাদ পড়িলে বা শুনিলে মনে হইবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং লুটেরা জনতা পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপর নির্যাতন চালাইতেছে। বিশেষ করিয়া গার্ডিয়ানের পাকিস্তান-দরদ মা অপেক্ষা বেশি। ২৫শে ফের সম্পাদকীয়তে বলা হইয়াছে বাঙালিদের Six point notorius উহাদের আন্দোলন Phoney, Flimsy, Shifting এবং Logical nonsense। উপরন্তু ইন্দিরাজীর ‘Facile Mischief এর জন্য এই সব অনর্থ বাধিয়াছে! অদ্য প্রভাতে মাসী গার্ডিয়ান আরও | ক্ষিপ্ত। আমেরিকা এবং CI.A নাকি বঙ্গবুন্ধকে স্নেহের চক্ষে দেখে। এই সংবাদটি CLA এর। হইয়া গার্ডিয়ান কিভাবে পাইলেন তাহা বলা হয় নাই। প্রবন্ধের শেষের দিকে বলা হইয়াছে বঙ্গবন্ধু শেখ “লুটেরা জনতার নেতা”। পরম আশ্চর্যের বিষয় এই যে লন্ডনস্থ রুশ ও চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তানিরা টাইমস গার্ডিয়ান ও বিবিসির সহিত একমত। (অবশ্য পশ্চিমবাংলার উভয় কমিউনিস্ট পার্টি শেখ মুজিবের এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে- ক, সম্পাদক মুজিব লুটেরা, বাক সর্বস্ব এবং ফুটা নৌকার তরুণ মাঝি। ১৯৩৮/৩৯ এ অর্থাৎ ত্রিপুরীর পূর্বে সুভাষ সম্বন্ধে রাজাগােপালাচারী একই কথা বলিয়াছিলেন। রুশ ও চীনপন্থী ভাইজানরা আমাকে তাচ্ছিল্যভরে বলিয়াছে-“দাদু, তিন মাস। হ্যার পর হালারে কাইটাকুইটা সাভার জলে ভাসাইয়া দিমু।’ ভূততা বা ইহাইয়া বা মৌলানা মৌদুদী তিনজনেই ইহাদের কাজে লাগাইতে পারে ইহাই হইল সর্বাপেক্ষা ভীতিপ্রদ ব্যাপার। অন্যান্য দেশের মানুষ মতবাদকে স্বদেশের কাজে লাগায়; বাঙালিকে মতবাদ নাকে দড়ি দিয়া ঘুরায়। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, “বাঙালি কি ইতিহাসের গাধা?”
গােদের উপর বিষেফোঁড়া হিসাবে আর এক গুজব কানে আসিল। ভূতাে শাসাইয়াছে যে প্রয়ােজন হইলে Cento ও Seato র নৌ, সৈন্য ও বিমান বাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে আনা হইবে। ইহার উপর দাদা আমেরিকা তাে আছেই। আমেরিকানরা কি এতই শক্তিমান যে উহারা প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান ও ভিয়েত্সাম তিন রণক্ষেত্রে এককালীন মােকাবিলা করিবে?
সুভাষচন্দ্রের পর এই প্রথম বাঙালি উপমহাদেশীয় রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারক। এ কারণে পূর্বপাকিস্তানিরা যদি একটু গােমর করে তাহা সম্পূর্ণভাবে ন্যায্য বলিয়া মানিতে হইবে। আজ কয়েক বৎসর পশ্চিমবঙ্গ নেতৃত্বহীন। পূর্বে একতা প্রায় সর্বাঙ্গীন। উহারা ত্যাগে, সাহসে এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় আমাদের অপেক্ষা অগ্রণী। উহারা আশা করে, আর কিছু না হৌক আমরা যেন উহাদের বাড়া ভাতে ছাই না দি। আজ উহারাই পাকিস্তান। উহারা ছাড়া যদি অন্য কোনও পাকিস্তান থাকিয়া থাকে তাহাতে এশিয়ার কিছু আসিবে যাইবে না।

লন্ডনের গুজব
সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁকে পূর্ব পাকিস্তান ২৫শে মার্চ অবধি সময় দিয়াছে। লন্ডনের গুজব রটনাকারীরা বলেন, খাঁ সাহেবের মেয়াদ নাকি আরও কম। সামরিক শাসনে কুপ কাপ প্রায়ই হইয়া থাকে কিন্তু এবার কার গুজবের সহিত রহিয়াছে রাজনৈতিক যুক্তি। মােদ্দা কথা হইল ইয়াহিয়া নাগিব; উহার সৈন্য বাহিনীতে এক আপাতত নামহীন কর্নেল পুঞ্জীভূত ক্রোধে, ব্যর্থতায় আত্মধিক্কারে ব্যাঘ্রের মতন ফুঁসিতেছেন। ইনিই পাকিস্তানের নাসের। ইনি স্কুলের ছাত্র হিসাবে ৪৭ এ কাশ্মীরের যুদ্ধের কথা শুনিয়াছেন। ৬২-র চীন ভারত যুদ্ধ লক্ষ করিয়াছেন এবং এবং ৬৫ র পাক-ভারত যুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিয়াছেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে বাঙালি মুসলমানদের প্রতি অবিচারে ক্রুদ্ধ; এনার মতে কাশ্মীরের নামে ভারতবিরােধিতা হইয়াছে, আর যে কাশ্মীরের জন্য এত কাণ্ড সেই কাশ্মীরের কিয়দংশ চীনের অন্তর্ভুক্ত। “আজাদ কাশ্মীরের মানুষ আজাদীর আ’ও দেখে নাই। মাঝখান হইতে পাকিস্তান ও ভারত বিদেশীর অর্থ ও সামর্থের উপর নির্ভরশীল। পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষ যুগযুগান্তসঞ্চিত ব্যথার বিরুদ্ধে অভিযান ঘােষণা করিয়াছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা প্রথমে ফৌজী হুঙ্কার ছাড়িয়া তখন ভিক্ষার ঝুলি হাতে ঢাকায় যাইতেছে। সশস্ত্র বাহিনী বেইজ্জৎ, বিশ্বের দরবারে তাহার প্রিয় স্বদেশে হাস্যাস্পদ। অদূরে পুণ্যভূমি প্যালেস্টাইন পর পদানত। এনার নিকট একমাত্র উপায়: বাঙালিকে ৬ দফা দিয়া এবং যুদ্ধবিরতি রেখায় দস্তখৎ করিয়া চল, পুণ্যভূমি প্যালেস্টাইন মার্কিনমুক্ত করি।
ইহা গুজব, হয়ত সমস্ত ব্যাপারটাই আজগুবি কিন্তু ইহার পশ্চাতে রাজনৈতিক যুক্তি সারা উপমহাদেশের মানুষের নিকট গভীর অর্থপূর্ণ। সকল কুপ এর নায়কের মতন পাকিস্তানের কর্নেল নাসের আজও অজ্ঞাত। এনার সহিত বাঙালির সম্পর্ক রক্তের না জন্মস্থানের? ইনি কি প্রাক্তন বিমান মহানায়ক আসগর খার অথবা প্রাক্তন মেজর জেনারেল আজল আঁর বিশ্বাসভাজন? কারণ এই দুই নায়কই বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধাভাজন! এই অজ্ঞাতকুলশীল কর্নেল যিনিই হউন ইনি আর অধিক দিন অজ্ঞাত থাকিতে পারিবেন।
০৫.০৩.৭১
[লেখকের ভবিষ্যতবাণী : “আজ ইহার সূচনা পূর্বভাগে দেখিলাম। শিশু বাংলা ভাষার গৌরব রক্ষার নিমিত্ত আত্মবলি দিতেছে। ইহা পশ্চিম ভাগে ঘটিলে আজ তাহার নাম পুণ্য শ্লোকভুক্ত হইত। যাহারা গতকাল বাঙালি বলিয়া পরিচয় দিতে লজ্জা বােধ করিত, আজ তারা অকাতরে প্রাণ দিতেছে; কাল উহারা জাতির জন্য প্রাণ দিবে। ইহা লেখকের ভবিষ্যদ্বাণী নহে ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে মানব শােণিতে যে কথা বুড়ীগঙ্গার নদী তীরে লিখিত হইয়াছে তাহারই পুনরুক্তি মাত্র। বাঙালি জাতির ইতিহাসের রথ কাদায় বসিয়া গিয়াছে। যাহারা ভাবে উহা চিরতরে থামিয়া গিয়াছে তাহারাই রথচক্রের অকস্মাৎ পরিক্রমণে উহার তলায় নিষ্পেষিত হইবে।”]।

সূত্র: যুগবাণী ২৯.৩.৫২

সূত্র: কম্পাস, ৩ এপ্রিল ১৯৭১