You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.03 | আমরা এপারের বাঙালিরা- অজিত কুমার দাশ | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

আমরা এপারের বাঙালিরা
অজিত কুমার দাশ

এপারের বাঙালিরা ওপারের ভাইবােনদের জন্য কি করছে কবেই বা আর করবে? সময় যে চলে যায়?
আমরা পশ্চিমবাংলায় যারা আছি, বসবাস করছি, আমরা কারা?- আমরা কি বাঙালি নই?
বারবার বাঙালি কথাটাই ব্যবহার করছি। পূর্ববাংলা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের আশা আকাঙ্খ বরাবরই তাে বাকী ভারতীয়দের থেকে একটু অন্যরকমের ছিল?
আর বাংলাদেশের বাঙালিরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, আমরা ওরা আসলে এক দেশেরই লােক এক রাষ্ট্রের না হতে পারি।
দুটি ইটালিয়ান যুবক ফোটোগ্রাফারও সাংবাদিক বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা চলে গিয়েছিল। ওদের একজন কোলকাতায় ফিরে এল ২৫শে মার্চ। ২৬শে থেকে ওখানে সামরিক আইন জারি হলাে। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে নিজেকে ঘােষণা করল।
ওরই মধ্যে ওকে আবার সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছি। ভারতীয় এমনকি পাকিস্তানি চেকপােস্টের লােকেরা ওকে বারণ করেছিল, কোথায় যাবে? গাড়ি নেই, রাস্তা ঘাট অবরুদ্ধ, সৈন্যবাহিনী উদ্দাম দাপটে যাকে পাচ্ছে খুন করছে তুমি যাবে কোথায়।
তবু কেন গেল? দুঃসাহসিক সাংবাদিকতার জন্যই শুধু নয়, নিজের চোখে শান্তিপূর্ণ অসহযােগের বাংলাকে দেখার পর রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাকে দেখার জন্যই শুধু নয়। সীমান্তে যাওয়ার পথে, যাওয়ার আগে বাঙালি মতে কাঁসার থালায় ডালভাত তরকারি তাড়াহুড়াে করে খাওয়ার সময় আমায়ও বারবার বলেছেন—জান, এমনটা হবে জানতাম না; বাংলাদেশকে আমি ভালােবেসে ফেলেছি। আজ— Jai Bangla is my Bangla…
বলেছে, ঢাকার পথে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে চলাফেরা করার জন্য যেখানে ইচ্ছা গিয়ে যতখুশি ছবি তােলার সময় ওই বিদেশী ছেলেদুটির একমাত্র পাসপোের্ট ছিল জয় বাংলা’ (জয় কথাটার ঠিক উচ্চারণ কিছুতেই করতে পারে না- জোয় বলে ফেলে)। যেখানে যাও। শুধু প্রাণখুলে বলাে ‘জয় বাংলা’ সবাই তােমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। ওকে ওরা নিয়ে গেছে যেখানে ইনজিনিয়ারিং ছাত্র, মেডিকেল ছাত্রীরা রাইফেল চালাতে শিখছে। কিন্তু দরকার নাহলে আমরা ব্যবহার করব না—আমরা শান্তিপূর্ণ থাকব” মনে করিয়ে দিয়েছে। ও ১০০ টাকা দৈনিক দিয়ে কন্টিনেন্টাল হােটেলে থাকেনি, দৈনিক ৮ টাকা ভাড়ায় দুজনে একটি ঘরে সস্তার একটি হােটেলে থেকেছে। বলেছে, তাতেই ওদের সুবিধা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণকে কাছে থেকে দেখতে, জানতে, ওদের সঙ্গে একাত্ম হতে।
এত বড়াে আন্দোলন গেল, প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ কমে এল তবু দাম বাড়েনি কোনও কিছুর। কোনও কোনও জিনিসের দাম সামান্য বেড়েছে, হয়তাে টাকায় ৫ পয়সা। তাতেও দোকানী হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছে দাম নেবার সময়। বলেছে, এর কমে আর পারি না।
বিদেশী মুদ্রার একটা গােপন বাজার পৃথিবীর সব দেশেই থাকে, যেখানে বিদেশী মুদ্রার আমদানি কম। ঢাকায় কিন্তু এত সত্ত্বেও হাজার চেষ্টা করেও কোনও বিদেশী ১টি ডলারও রাষ্ট্রের বাইরে বেশি দামে বেচতে পারেনি। একটি পাউন্ডও নয়।।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্র ওখানে এ কয়দিন উন্মুক্ত ছিল। মুজিবর সাহেব প্রকাশ্যে বলে দিয়েছিলেন সব জনসভায়, বাংলাদেশে সংবাদ স্বাধীনতা পুরােপুরি থাকবে। বিদেশী সাংবাদিকদের বাধা দিও না, ওদের সাহায্য কর।
সেই সাহায্যের ভরসায় ছেলেটি শুক্রবার আবার বাংলাদেশের জঙ্গী সান্ধ্য আইনের সন্ধ্যায় একা চেকপোেস্ট পেরিয়ে জনগণের কাছে গেছে তাদের সঙ্গে দুঃখে সগ্রামে একত্রে থাকতে।
ঠিক চেকপোেস্ট পার হবার আগে আমার হাতে ছােট্ট একটি চিরকূট দিয়ে বলে গেছে এখানে আমার মার নাম, আমার বাবার নাম ঠিকানা। যদি কিছু হয়, যদি না ফিরি তবে ওদের খবর দিও। বলাে পরম আত্মীয়দের মধ্যেই মরেছে।
বলেছি না তুমি ফিরবে, ফিরবে, আমি তােমার কাছে আরও কত অভিজ্ঞতা শুনব।
বলেছে ফিরলে “A Picture Book of Bengal” বলে বই লিখবে, দুই বাংলা মিলিয়ে “Because you know I find, you on two sides the same, the same.”
76169, You ought to be proud, you are a Bengallee.”
আজ কিন্তু বাঙালি হিসাবে পশ্চিমবাংলায় আমাদের গর্ব করার কিছু নেই। আমরা বাঁচতে জানি না বাঁচাতে জানি না। ট্রামের গায়ে পড়ছি ভারত সরকারের নিবেদন বেঁচে থাকুন বাঁচতে দিন”।
থচ পূর্ব বাংলার বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে লােকসভায় ইন্দিরাজী বলেছেন সহানুভূতি আছে তবে ভেবে চিন্তে চলতে হবে।
বাঙালি বলে যদিওবা ওপার বাংলার কৃতিত্বে আমরা কিছুটা গর্ব অনুভব করতে পারি, নিজেকে ভারতীয় ভাবতে আজ এই মুহূর্তে লজ্জা করছে। (২৮.৩.৭১)

সূত্র: কম্পাস, ৩-৪-১৯৭১