বাংলাদেশে শরণার্থী সমস্যা
মহাশয়,
বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা একাধিক সমস্যাসংকুল পশ্চিম বাংলার একটি জীবনমরণ সমস্যা। এ সমস্যার জন্য পশ্চিম বাংলা তথা ভারত আদৌ প্রস্তুত ছিল না। অথচ সমস্যা মানবতার খাতিরেই বৃহত্তম ও জরুরি কর্তব্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জোরের সঙ্গে বলেছেন যে ছয় মাস পরেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে শরণার্থীরা আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু ঘটনার গতি প্রকতি দেখে মনে হয় লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের বােঝ দীর্ঘ কালের জন্য এদেশে বহন করতে হবে। যে সংখ্যক শরণার্থী ইতিমধ্যে এসেছেন তা আরও বাড়বে। এ বিরাট দায়িত্ব রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থিক, সামাজিক ও ভরণপােষণের দিক থেকে এ রাজ্যকেই অনন্যোপায় হতে গ্রহণ করতে হচ্ছে। ফলে রাজ্যের ভঙ্গুর অর্থনীতি আরও বিপর্যস্ত হতে চলেছে। খুন, হত্যা, রাহাজানি ও প্রতিদিনের অশান্তি দমনে রাজ্যের সরকারী প্রশাসন আজও সফলকাম হতে পারেনি। তদুপরি সীমান্তের শরণার্থী শিবির রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিদিনের খাওয়ানাে পরানাের ব্যবস্থাপনায় প্রয়ােজন সরকারী কর্মচারী, নিরাপত্তা বাহিনী ও পু ইত্যাদির একটা বিরাট সংখ্যাশক্তি।
শরণার্থীদের ভরণপােষণ ও সাহায্যের প্রশ্নে অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের সমবেদনা কুম্ভীরাশ্রুর সামিল। তাদের আচরণ ও মনােভাব বেদনাদায়ক। রাষ্ট্রপুঞ্জের ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের প্রধান শ্রীমেইসের নেতৃত্বাধীনে প্রতিনিধিবর্গের বিবরণী কতটা রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানে সক্রিয় সাহায্যের কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে তা এখুনি বলা কষ্টকর। কারণ রাষ্ট্রসংঘ প্যালেস্টাইনের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরােপের অন্যান্য রাষ্ট্রে উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে যেরূপ অকৃপণ সাহায্য দান করেছে বাংলাদেশ থেকে আগত আশ্রয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম গভীর পীড়াদায়ক ও নিন্দনীয়।
রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে ভারত সরকারের ২০০ কোটি টাকার দাবী অত্যন্ত ন্যায়সংগত হলেও প্রয়ােজনের তুলনায় নিতান্ত কম। রাষ্ট্রপুঞ্জ বা অন্যান্য রাষ্ট্রগুলাের সাহায্যের প্রত্যাশায় কালবিলম্ব না করে শরণার্থীদের অবশ্যই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার আশু কাজ আমাদের নিষ্ঠার সঙ্গেই করতে হবে।
পশ্চিম বাংলার পরই আসাম ত্রিপুরা ও মেঘালয়-এ তিনটি রাজ্যের উপর শরণার্থীদের প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। চারটি রাজ্যের উপর আর্থিক চাপ অস্বাভাবিক ভাবেই দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এর মারাত্মকতা ও পরিণাম নানা দিক থেকে আজ বিচার করবার সময় এসেছে। শরণার্থী শিবিরগুলাে সাধারণত চারটি রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলের শরণার্থীদের মধ্যে যারা বাপ, মা, ভাইবােনদের হারিয়েছেন তাদের কাছে সুস্থ সমাজ জীবনের আকর্ষণ বা মানসিকতা না থাকাই স্বাভাবিক। হয়ত তাদের মধ্যে পশ্চিম বাংলার ক্রমবর্ধমান অপরাধমূলক কাজকর্মের প্রতিফলন পড়বে ও আস্তে আস্তে সমাজ জীবন ব্যাধিগ্রস্ত হবে। পশ্চিম বাংলার বােমা, ছােরা, পিস্তলের তথাকথিত এ্যাড়ভেচারইজিমের স্পর্শ তাদের মনকেও দোলা দেবে, প্রভাবিত করবে।
তাছাড়া ইয়াহিয়ার এজেন্টরা বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধবাদী লােকেরা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সমর্থকের ভেক ধরে শরণার্থী শিবিরে সকলের সঙ্গে মিশে যাবে। শিবিরের যুবক যুবতীদের প্রলােভন দেখিয়ে ও নানা রকম শলাপরামর্শ দিয়ে বিপথগামী করার অপচেষ্টা চালাবে। শিবির জীবনের অনিবার্য কষ্টকর পরিবেশের সুযােগ নিয়ে সরল প্রাণ মনগুলােকে বিষিয়ে তােলার রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চালাবে। এসব বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের শরণার্থীদের সামাজিক মূল্যবােধ সম্পর্কে সচেতন করে তােলবার কাজে বিশেষ মনােযােগ দিতে হবে, অপরদিকে তেমনি শিবিরের সরকারী প্রশাসন ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে শরণার্থীদের পরিবারের সাধারণত: একজন অপরজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। একের সঙ্গে অপরের কোনও যােগাযযাগ নেই। তাদের মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থা যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ও পরস্পর যাতে এক সঙ্গে শিবিরে বসবাস করতে পারেন তার ব্যবস্থা কষ্টসাধ্য হলেও ধীরে ধীরে করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ এ রাজ্যে চলে এসেছেন তাদেরও শিবিরের কাছাকাছি অঞ্চলে ভ্রাম্যমান বিদ্যালয় বা ইমারজেন্সী শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শরণার্থীদের সন্তান সন্ততিদের মধ্যে শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তাবােধ ও ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের ভরণপােষণের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পশ্চিম বাংলা সরকারকে রাজ্যের অতি লােভী ও মুনাফাখখার ব্যবসায়ীদের প্রতি উদাসীন থাকলে চলবে না। তারা যাতে নিত্যপ্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়ােজন। কারণ ইতিমধ্যেই একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা বাজার দরের ক্ষেত্রে কিছু কিছু সুযােগ নিতে শুরু করেছেন।
পরিশেষে বড় প্রশ্ন হচ্ছে পশ্চিম বাংলার পক্ষে এতবড় বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ শরণার্থী সমস্যার বােঝা বহন করা আদৌ সম্ভব নয়। ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় এ তিনটি সীমান্ত রাজ্য দায়িত্ব গ্রহণ করা সত্ত্বেও সমস্যার সমাধান সহজসাধ্য নয়। অন্যান্য পাশাপাশি রাজ্যগুলােকে শরণার্থীদের দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে।
এক কথায় বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাটিকে দীর্ঘস্থায়ী জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা বা গুরুতৃপ্রদান না করলে পশ্চিম বাংলারই শুধু ক্ষতি হবে না, গােটাদেশকে নিশ্চিত পরিণাম হিসেবে সে ক্ষতির বােঝা স্বীকার করতে হবে। গােটা জাতি বিষময়ফল ভােগ করবে। তাই রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আজ সমস্যাটিকে নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে সতর্ক থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে শরণার্থী ও অন্যান্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান আশু প্রয়ােজন ও জাতীয় কর্তব্য হিসেবে ভারত সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
যতীন কর্মকার
কলি-৩২
সূত্র: কম্পাস, ২৯শে মে ১৯৭১