বাংলাদেশের একটা ঘটনা
মহাশয়,
সেদিন কয়েকজন মিলে গঙ্গারঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলাম। খেজুরিয়া ঘাট থেকে জাহাজ এসে ভিড়ল। এক এক করে যাত্রীরা নামতে লাগল, ওপার বাংলা থেকে আগত কিছু যাত্রীর সঙ্গে আলাপ করে ওখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে চাইলাম। তার আগে হঠাৎ চমকে উঠলাম, জনৈক যাত্রীর মুখে চট্টগ্রামের ভাষা শুনে। কারণ আমরাও দলের মধ্যে ৪/৫ জন চট্টগ্রামী ছিলাম। দেখলাম জাহাজের নিচের তলার মেঝেতে চাদর পেতে বসে আছেন একটি মাঝ বয়েসী ভদ্রলােক, ও তাঁকে ঘিরে বসে আছে প্রায় ১০/১২ জন বড় মেয়ে। দেখি, কেউ বমি করছে, কেউ কাঁদছে, কেউ চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সবাই নেমে গেছে, কিন্তু ওরা নামতে পারছে না। সবাই ওরা দারুণ দুর্বল। ভদ্রলােককে ঘিরে আমরা অনেক প্রশ্ন করলাম। ঐ দ্রলােকটির মুখে শােনা, তারই ভাষায় কিছু কথা আমরা নিচে উল্লেখ করলাম–
“প্রায় ১১ দিন উপােসে কথা বলার শক্তি নেই মা! তবু আপনাদের না বলে পাচ্ছি না। চট্টগ্রামের দেয়ানপুর গ্রাম থেকে আমরা আসছি। ওখানে এখন পাক সেনারা সামনের দিকে গুলি করে এগুচ্ছে এবং হিন্দুর বাড়ি বেছে বেছে আক্রমণ চালাচ্ছে। চোখের সামনেই মা-বাবাকে মেরে ও ছােট ছােট ভাইবােনদের মেরে বড় মেয়েদের ওদের গাড়িতে তুলে নিচ্ছে। ওদেরকে ‘গাইড’ করে নিয়ে যাচ্ছে একদল বাঙালি মুসলমান। তথাকথিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ওদের হাতে আছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম আসলে ওরা মুসলিম লীগ। ওরাই এখন আওয়ামী লীগের ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগের উপর দুর্নাম চাপিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ সমর্থক লােকের উপরও নির্যাতন চালাচ্ছে। আমার পরিবারের কাউকে আমি বাঁচাতে পারিনি। রাস্তায় অসহায় পাগলের মতাে ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েকে ছুটতে দেখেছি। আমার নিজের কারে” যতজন সম্ভব তুলে নিয়েছি। উল্টো রাস্তা দিয়ে কিছুটা আসার পর মনে হ’ল পেছনে কারা যেন আমার গাড়িটা অনুসরণ করছে। বুঝতে পেরে আমি রাস্তায় গাড়িটা রেখে সবাইকে নামিয়ে একটা ঝােপের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রায় না খেয়েই এই এগার দিনে পায়ে হেঁটে (ভাগ্যে, মাঝে মাঝে অবশ্য গাড়িও পেয়েছি) সােনামুড়ায় পৌছাই। তারপর ওখান থেকে ট্যাক্সী বাস, ট্রেনে আগরতলা, গৌহাটী, করিমগঞ্জ হয়ে এদিকে যাচ্ছি হালিশহর।”
আমরা যারা পূর্ব বাংলা থেকে লাঞ্ছিত বিতাড়িত হয়ে এখানে চলে এসেছি এ কথা শােনার পর তাদের মনের অবস্থা কী হয় তা আপনারাই বলুন। তবুও আমরা যথাসম্ভব সাহায্য করে যাচ্ছি, ওপার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের আমরা এখনাে বলছি, পূর্ব বাংলা স্বাধীন হােক। ওরা বাঁচুক, ওরা শােষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলুক।
কৃষ্ণা ও রূপা ফরাক্কা, মুর্শিদাবাদ।
৮.৫.১৯৭১
চিঠিপত্র
যে যুদ্ধের শেষ নেই।
মহাশয়,
পূর্ববাংলার এ জনযুদ্ধের শেষ হবে কবে কেউ তা বলতে পারছেন না। প্রথম পর্ব শেষ হয়ে দ্বিতীয় পর্ব সবে শুরু হয়েছে, এখনও কত পর্ব বাকী কে বলতে পারে? প্রথম পর্বে ইয়াহিয়ার সৈন্যেরা জয়লাভ করেছেন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। বিদেশি পত্র পত্রিকার রিপাের্টারদের বিবরণ থেকে মনে হচ্ছে যে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং প্রথম শ্রেণীর যােদ্ধাদের নিয়ে গঠিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনে কোনখানেই মুক্তিফৌজ দাঁড়াতে পারেনি যেমন ধারালাে ছুরির সামনে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায় মাখনের তাল তেমনটাই ঘটেছে। যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে কিন্তু ঠিক এর উল্টোটাই ঘটবার সম্ভাবনা যদি এই যদিটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা (১) স্বাধীনতা সগ্রামীদের মনােবল বর্ষা পর্যন্ত টিকে থাকে। (২) ভারত যদি সরকারি ও বেসরকারি সূত্রে প্রয়ােজনীয় উপকরণাদির যােগান দেয়। ঐ উপকরণগুলাের মধ্যে সবচেয়ে প্রয়ােজন হলাে বন্দরগুলােকে অকেজো করে দেওয়ার জন্য একান্ত প্রয়ােজনীয় লিম্পেট মাইন, বিমান ক্ষেত্রগুলােকে অকেজো করে দেওয়ার জন্য ইনসেন্ডারি গ্রিনেড এবং গ্রিনেড ছোড়ার উপযুক্ত রাইফেল এবং রেলপথ ও সেতুগুলাে ধ্বংস করবার উপযুক্ত ছােট ছােট হাই-এক্সপ্লোসিভ চার্জ। এগুলাের যােগান দেওয়া ভারতের পক্ষে খুবই সহজ কিন্তু তার আগে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
সুতরাং এই যুদ্ধের সাফল্যের জন্য ভারতের ভূমিকা এখন মুখ্য হতে বাধ্য। যদি ভারত সহায়তা দিতে ভয় পায় বা নীতিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে সরে থাকতে চেষ্টা করে তবে ইতিহাস কখনও তাকে ক্ষমা করবে না। শুধু তাই নয়, ভারত যদি সাহায্য না দেয় তবুও পূর্ববাংলা অনেক বেশি দুঃখ-দুর্দশা, দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে হয়ত স্বাধীনতা লাভ করবে দীর্ঘকাল পরে কিন্তু তখন সেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বজায় থাকবে কি?
এ পর্যন্ত ভারত থেকে সরকারি সূত্রে যেটুকু সাহায্য দেওয়া হয়েছে তা প্রধানত প্রচারের মাধ্যমে। এর ফলে বিশ্বজনমত সৃষ্টি হয়েছে, যদিও ইউ, এন, ও, সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যাওয়ার ফলে এই জনমতের মূল্য খুবই কম। ভারতীয় বেতার কেন্দ্রগুলাে খুবই সাহায্য করেছে এবং উৎসাহ যুগিয়েছে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা কামীদের। দেশাত্মবােধক গানগুলাে যদিও উন্মাদনার সৃষ্টি করে তবুও আমরা আমাদের ১৯৬২ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে এর দ্বারা যুদ্ধে জয়লাভের কোনােই সুবিধা হয় না।
আমাদের সংবাদপত্রগুলাে তাদের অতি উৎসাহের ফলে সাহায্য যা করতে পেরেছে পরােক্ষভাবে ক্ষতিসাধন করেছে বােধ হয় তার থেকে বেশি। ইংরেজি কাগজগুলাে বিদেশেও যায় এবং বিদেশের পাঠকরা আমাদের সাংবাদিকদের সামরিক জ্ঞানের স্বল্পতায় যেমন মুখটিপে হেসেছেন তেমনি বিবরণীগুলাের অসংলগ্নতায় তাদের মনে নিশ্চয় সংশয়ও জেগেছে যে এই সকল বিবরণ সত্য কিনা। আমাদের খুব কম সাংবাদিক নাপাম এবং ইনসেন্ডারির মধ্যের বা মর্টার ও হাউইটজারের মধ্যে পার্থক্যটা ঠিক মতাে বােঝেন। LST এবং গানবােট যে এক নয়, মেশিনগান এবং বিমান মারা কামান যে একেবারে আলাদা এ সকল জ্ঞান তাদের না থাকায় বিশেষত ফটোগুলাের তলায় যা লেখা হয়েছে তা পড়লে যে কোনাে শিক্ষিত বিদেশীর হাসি পাবে বা সন্দেহ হবে। কিন্তু লন্ডন টাইমস, অবজার্ভার বা অন্যান্য যুগােশ্লাভ ও ইটালীয় পত্রিকার সংবাদদাতারা আমাদের কাগজগুলােতেই যে সকল বিবরণ দিয়েছেন তা খুবই স্পষ্ট এবং জ্ঞানসমৃদ্ধ। ওয়ার করেস্পন্ডেন্টের পরম্পরা গড়ে উঠতে অবশ্যই সময় লাগে; কিন্তু ১৯৬২ এবং ১৯৬৫-র পরেও আমাদের সাংবাদিকতার এই কটি ১৯৭১ সালে প্রকাশ পেলে তা খুবই লজ্জার কথা হয় না কি?
পাকিস্তানের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে যে তার এই মরণ বচন যুদ্ধ সত্ত্বেও সে ভারতের সঙ্গেও আর এক রাউণ্ড লড়তে চাইছে। জগজীবন রাম যে Stunning reply এর কথা বলেছেন তা দিতে হলে ভারতকে আরও বেশি প্রস্তুত হতে হবে। প্রচুর পরিমাণে আধুনিক সমরযন্ত্র এবং লােকবল থাকা সত্ত্বেও ভারতের যেন সেই মানসিকতার অভাব রয়েছে বলে মনে হয় যা থাকলে পাকিস্তান ভারতের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে ভয় পেত; কারণ সামরিক শক্তিরূপে পাকিস্তান তাে ভারতের কোনাে প্রতিপক্ষই নয় এমন আকাশ পাতাল তফাৎ দুদেশের সামরিক বলের মধ্যে। তবুও পাকিস্তানের এই সাহসের কারণ কী? চীন? আরব ইরান তুর্কির আর্থিক সাহায্য? কোনােটাই নয়, কারণ বিপদের সময় কোনােটাই পূর্বেও পাকিস্তানের কোনাে কাজে আসেনি, পরেও আসবে না তা বােধ হয় পাকিস্তানের চেঙ্গিস খায়ের জুড়িদাররা জানেন।
ব্যাপারটা হলাে বােধ হয় এই রকম। যেমন জার্মানিতে প্রাশিয়ান জাঙ্কার পরম্পরা ছিল, সামরিক গৌরবের একটা বনেদীয়ানার ভাব, পাকিস্তানেরও তাই হয়েছে। জার্মানি যেমন ১৯১৪ সালে এবং ১৯৩৯ সালে ভেবেছিল যে তাদের মতাে যােদ্ধাজাত আর কে আছে? আজ পাকিস্তানও বােধ হয় তাই ভাবছে ভেতাে বাঙালিগুলাে আবার লড়তে পারবে! এই দেমাকটা ভেঙে দেওয়া দরকার চিরকালের মতাে। এবং তা ভারত আজ ইচ্ছা করলেই পারে। ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজ, লন্ডন অথবা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজের রিপাের্টগুলাে-যা আমাদেরই পত্র পত্রিকাদিতে এর আগে প্রকাশ হয়েছে সেগুলাে দেখলেই বােঝা যাবে যে ভারত ইচ্ছা করলেই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে পারে এ সামর্থ তার আছে। কিন্তু এ সাহস ও মনােবল তার আছে কী? কাশ্মীর সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান একমাত্র পূর্ব বাংলার রণক্ষেত্রেই হতে পারে এই কথাটা আজ কেন্দ্রীয় সরকারকে বুঝিয়ে দেবে কে? তা হলে ভারতেও একজন কার্ল হাউসােফার চাই।
সুদিন ভট্টাচার্য
কলিকাতা
বিজ্ঞপ্তি
পাকসৈন্যের বর্বরতার সচিত্র নিদর্শন সম্বলিত একটি পােস্টার কম্পাস’ পত্রিকা প্রকাশ করেছে। যারা নিজের নিজের এলাকায় সেগুলাে লাগাতে উৎসাহী তারা এই পত্রিকার সাথে যােগাযােগ করতে পারেন।
সূত্র: কম্পাস, ১৫ই মে ১৯৭১