পুস্তক সমালােচনা
Pakistan Elections – By Asit Bhattacharya, Compass Publications Ltd. Cal. Price Rs. 1.5
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মাঝরাতে ভারতের বুকে জন্ম নিল একটা নতুন রাষ্ট্র। যার নাম পাকিস্তান। এ রাষ্ট্রের দুটি অংশ পূবে আর পশ্চিমে। এ দুটি অংশের দূরত্ব হাজার মাইলেরও বেশি। অর্থাৎ এ রাষ্ট্রের ভৌগােলিক সংহতি নেই। শুধু কী তাই! এ রাষ্ট্রের অধিবাসীরাও ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সাহিত্য, লােকাচার, দেশাচার ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন। পুবের সঙ্গে পশ্চিমের কোনাে মিলই নেই- একমাত্র ধর্ম বিশ্বাস ছাড়া।
অবশ্য এটা স্বীকার করতেই হবে যে শুধু ধর্ম বিশ্বাসগত সংহতির কারণেই এ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। এ যেন মধ্যযুগের ইউরােপের বুকে গড়ে ওঠা একটা পবিত্র ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের সংগঠন।
যা হােক, পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে এ রাষ্ট্রের উদগাতা পরলােকগত মহম্মদ আলি জিন্না বললেন, ভারত উপমহাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাদের মনােমত রাষ্ট্র গঠনের সুযােগ শেষ পর্যন্ত পেলেন। এখন এ রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। আর এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে রাষ্ট্রে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ—সেখানে অন্যান্য ধর্ম, মত ও বিশ্বাসের মানুষদেরও নাগরিক অধিকার মেনে নিতে হবে।
তবে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের এক বছরের মধ্যে মহম্মদ আলি জিন্নার মৃত্যু হয়েছিল। তাই পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন ও নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি কোনাে কাজেই হাত দিতে পারেননি।
প্রথম দিকে কয়েক বছর পাকিস্তানে চলেছিল ইসলামের ধ্বজাধারীদের মধ্যে পারস্পরিক কেদল ক্ষমতা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে পশ্চিম পাঞ্জাবের বড় বড় জমিদার, আমলাতন্ত্র আর সামরিক নেতারা। এই জমিদার আমলা ও সামরিক নেতারা কিন্তু পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাইল না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে অপারগ পাকিস্তানের নতুন শাসক গােষ্ঠি ইসলাম সম্পর্কে জিগির তুললাে, যদিও তারা জানতে পাকিস্তান প্রায় সম্পূর্ণরূপে মুসলমান ধর্মাবলম্বদের দ্বারা অধ্যুষিত।
জিন্নার মৃত্যুর পরে অখণ্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অন্যতেম প্রধানমন্ত্রী পরলােকগত সােহরাওয়াদাও চেয়েছিলেন পাকিস্তানে আধুনিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের ও শাসনতন্ত্র রচনার ব্যবস্থা। কিন্তু তা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাবী শাসকগােষ্ঠী বিশেষত পশ্চিম পাঞ্জাবের সামরিক চক্র বরাবর বিরােধিতা করে এসেছে ধর্মনিপেক্ষ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে।
জিন্নার পরবর্তীকালে যারা পাকিস্তানের সর্বময় কর্তৃত্ব অর্জন করেছেন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত, তারা কেউই প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে আধুনিক শাসন ব্যবস্থা চালু করতে চাননি। একনায়কতন্ত্রই সেখানে কায়েম হয়ে এসেছে। কখনও এই একনায়কতন্ত্র অসামরিক, আবার কখনও বা সামরিক রূপ নিয়েছে মাত্র। এই একনায়কতন্ত্র বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী জনসাধারণকে ধর্মের ভিত্তিতে উর্দু ভাষাভাষী হিসেবে গড়ে পিটে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হলাে না পাকিস্তানের পূর্ব অংশ অর্থাৎ পূর্ব বাংলার জনসাধারণের কারণে। পরে পূর্ব বাংলার মানুষদের মতাে পাখতুন, সিন্ধী আর বালুচীরাও নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দাবীদার হয়ে উঠল। এ কারণেই সামরিক একনায়ক ইস্কান্দার মীর্জা ও আয়ুব খানের পরে যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে নিয়ে একটা ইউনিট গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে মার্চ মাসের পরে বর্তমানের একনায়ক ইয়াহিয়া খান ঐ এক ইউনিট প্রথা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
তবে পাকিস্তানের সামরিক গােষ্ঠির নিয়ন্ত্রণাধীন শাসকগােষ্ঠি সব চাইতে বেশি বিরােধিতার সম্মুখীন হয়েছেন পূর্ব বাংলার জনসাধারণের কাছে। এ বিরােধিতার কাল শুরু হয়েছে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখ থেকে- যেদিন বাংলাভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে চারজন ছাত্র প্রাণ দিলেন। তারপর থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষ, ছাত্ররা, বুদ্ধিজীবীরা ও জাতীয়তাবাদী বাঙালি নেতারা দাবী তুলতে শুরু করলেন- একের পর এক। শেষ পর্যন্ত তারা মুখর হয়ে উঠলেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবী ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে।
১৯৭০ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের উভয় অংশে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার গুরুত্ব উপরােক্ত পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেচনা করতে হবে। লেখক অসিত ভট্টচার্যের আলােচ্য পুস্তিকাটিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন সময়ে অর্থাৎ, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৪ এবং ১৯৭০ সালে ঐ দেশে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সব প্রচেষ্টা হয়েছে তা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। আয়ুব সরকারের বৈশিষ্ট্য ১৯৬৫ সালে কচ্ছে ও কাশ্মীরে পাকিস্তানি অভিযান, তাসখন্দ চুক্তি পালনে আয়ুবের অস্বীকৃতি, পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে নতুন জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থান, জাতীয় আওয়ামী দলে ভাঙ্গন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট চীনের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট লিউ-সাও-চি’র পাকিস্তান পরিদর্শন, জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের নেতা ভাসানীর রাজনীতিতে স্ববিরােধিতা, ইয়াহিয়া খানের নির্বাচন সম্পর্কীয় ঘােষণা, পূর্ববাংলায় আওয়ামী লীগের ছ’দফা দাবী এবং ছাত্রদের ১১ দফা দাবী সম্পর্কে অল্প কথায় সুন্দরভাবে আলােচনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য যে ২৫শে মার্চে পূর্ববাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও সামরিক চক্রের নির্মম নিপীড়নের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে যে গণ আন্দোলন শুরু করেছেন, তার গুরুত্ব অনুধাবন করার পক্ষে আলােচ্য পুস্তিকাখানি যথেষ্ট সাহায্য করবে। তাই আমরা পাঠক সমাজে অসিতবাবুর এই পুস্তিকাখানির বহুল প্রচার কামনা করি।
রণজিৎ সেনগুপ্ত
সূত্র: কম্পাস, ১৫ই মে ১৯৭১