You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.01.08 | হে ভারত বিদায়- শরণার্থী | সংগ্রামী বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

সংকলন
হে ভারত বিদায়
শরণার্থী

হে ভারত। প্রায় ৮ মাস তােমাদের আতিথ্য গ্রহণের পর আজ আমরা দেশে ফিরে চলেছি। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলার মাটিতে যে বাংলায় আমাদের জন্ম, আশৈশবে লালিত পালিত, যে বাংলা মায়ের বুকে, সেই মায়ের বুকে ফিরে চলেছি।
হে করুণাময়ী যে দিন আমরা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলাম, দেশে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা ছিল , মৃত্যু আর বিভীষিকা, হত্যা লীলায় সমস্ত বাংলাদেশ ছিল বধ্যভূমি। সেদিন তুমি এক কোটি জনতাকে আশ্রয় দিয়েছিলে, খাদ্য দিয়েছিলে, আশা দিয়েছিলে, ভরসাও দিয়েছিলে। কোটি কোটি লােকের জীবনের নিরাপত্তার জামিন হয়েছিলে। তােমাদের আন্তরিকতা, ভালােবাসা, বন্ধুত্বের প্রমাণ আমরা পেয়েছি। তােমাদের বন্ধুত্বের পেছনে কোনাে লােভ, লালসা, বা শাসন শােষণের আকাঙ্খ ছিল না। স্বাধীনতা গণতন্ত্র শান্তির প্রতি অবিচল নিষ্ঠা নিয়ে দুর্দিনে বাঙালি জাতিকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলে; আলিঙ্গন করেছিলে। তার জন্য তােমাদের জনসাধারণকে অনেক কৃচ্ছ সাধনা করতে হয়েছে অনেক দুঃখ বেদনার দারিদ্রতার বােঝা ও বহন করতে হয়েছে। তবুও তােমরা অতিধির অবমাননা করনি। গলা ধাক্কা দিয়ে তাদের তাড়িয়ে দাওনি, আমরা একথাও জানি এখানে অভাব আছে, অনাহার আছে, দারিদ্র আছে, এখানেও চোখের জল ঝরে। অনেকে বিদ্রি রজনী যাপন করে। এখানেও অনেক বসন্ত রিক্ত হস্তে ফিরে যায়। এখানেও আকাশে বাতাসে বহু আশা আকাঙ্খও শান্তির জন্য কেঁদে বেড়ায়। তা সত্ত্বেও হে ভারত, বিপদের দিনে, সগ্রামের দিনে তােমরা আমাদের আশ্রয় দিয়েছ, অস্ত্র দিয়েছ, অর্থ দিয়েছ, খাদ্য দিয়েছ, বস্ত্র দিয়েছ। দিয়েছ স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও শান্তির আশ্বাস। শুধু তাই নয়, তােমাদের বীর সৈনিকেরা বাঙালির মুক্তিযোেদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে বাংলার মুক্তির জন্য। একে একে মুক্ত করেছে বাংলার সমস্ত জনপদ, শহর বন্দর।
হে মহান ভারত, যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েও চরম বিপদের মধ্যে তােমরা স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছ। পাক জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছ। বাংলার স্বাধীনতা সাড়ে সাত কোটি জনতার দাবীকে বাস্তবায়িত করার শপথ নিয়ে ৫৫ কোটি জনতা আজ মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ৫৫ কোটি জনতার জীবন, সম্পদ, স্বাধীনতা, শান্তি আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছ। অন্য একটি জাতির জন্য একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য এই যে ত্যাগ তার কোনাে তুলনা নাই বিশ্বের ইতিহাসে।…এই ভারতের মহামানবের তীরে দাঁড়িয়ে বিদায় বেলায় ডাক দিয়ে যাই: দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য আমরা যেভাবে মহাতীর্থে সম্মিলিত হয়েছি; পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যেমন করে যুদ্ধ করছি দুঃখ কষ্ট বরণ করছি, রক্ত নদীকে যেমন করে অতিক্রম করছি, আগামী দিনেও যেন আমরা পৃথিবীর মানুষের স্বাধীনতা, শান্তি, প্রগতি ও সুখ শান্তি প্রতিষ্ঠার সগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে পারি।
হে মহান ভারত, চোখের জল ফেলে আজ আমরা বিদায় নিচ্ছি না। আজ আমরা বিদায় নিচ্ছি হাসিমুখে। ২৩ বছর আগে আমরা ছিলাম তােমারই সাথে। কালের চক্রে আমরা হয়েছিলাম পৃথক। তা সত্ত্বেও ভুলতে পার নাই। তাই আজ বিপদের দিনে দুঃখের দিনে, সংগ্রামের দিনে তুমি আমাদের কোলে তুলে নিয়েছ। কিন্তু আমরা শােষণের ভয়ে আলাদা হলাম সুখ, শান্তির আশায়। সে সুখের সংসার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমরা বাঙালিও হতে পারি নাই, পাকিস্তানিও হতে পারি নাই। হয়েছিলাম শুধু মুসলমান। মানুষ হওয়ার সমস্ত অধিকার ছিল অবরুদ্ধ। কারাগারের আসামীর মতাে ২৩ টা বছর আমাদের কেটেছে। আমরা হয়েছি শােষিত, শাসিত নির্যাতিত। তাই আজ বাঙালিরা বিপ্লবী, অস্ত্র হাতে নিয়ে সগ্রাম করছি। সমস্ত স্বৈরাচারী শাসক ও শােষকদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। হে ভারত। স্বাধীনতার যুদ্ধে আদর্শের রণক্ষেত্রে আমরা আবার মিলিত হচ্ছি। মহামিলনের জয়গানে মুখরিত এই উপমহাদেশ। দুই যুগ আগে এক দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। সেই বিয়ােগান্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার জন্য লৌহ কঠিন হস্তে সাম্প্রদায়িকতার, ধর্মান্ধতার চিহ্ন মুছে দিতে হবে। যে কারণে আমাদের মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল অবিলম্বে তার সমাপ্তি ঘটাতে হবে। শােষণ আর ধর্মান্ধতাকে নির্মূল করতে হবে। আমরা সংগ্রাম করছি শােষণের বিরুদ্ধে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। সংগ্রামের মধ্যে, রক্তের মধ্যে আমাদের মিলন। তা কোনাে স্বার্থপরতার আঘাতে চূর্ণ হবে না। আজকের মতাে ভাবীকালেও যেন সত্য ন্যায়, নীতি ও আদর্শের জন্য একসাথে সংগ্রাম করে যেতে পারি। আমাদের কণ্ঠ যেন কোনাে মতেই স্তব্ধ না হয়। আমরা এই পৃথিবীর জনগণের জন্য নূতন সমাজ, নূতন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য একযােগে সংগ্রাম করব। সেখানে শােষণ থাকবে না, অত্যাচার অবিচার থাকবে না, সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ থাকবে না। আমরা সগ্রাম করব বিশ্বমানবতার সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধির জন্য। আমরা নতুন বিশ্ব গড়ে তুলবে।
পরাধীনতার মধ্যে আমরা এসেছিলাম আজ স্বাধীনতা নিয়ে দেশে চলেছি। বিজিত ছিলাম এখন হয়েছি বিজয়ী। স্বাধীনতা পরাধীনতাকে পরাজিত করেছে। গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রকে হত্যা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা ভারতের ৫৫ কোটি জনতাকে হৃদয় নিংড়ানাে ভালােবাসা দিয়ে গ্রহণ ভারতের যে কোনাে জাতীয় দুর্যোগে বাঙালি জাতি তার সর্বশক্তি দিয়ে তাকে সাহায্য করবে। আলাদা দেশ হলেও আমরা ভারতের সুখে হব সবচেয়ে সুখী, দুঃখে সবচেয়ে দুঃখিত। ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। বন্ধুত্বের মর্যাদা বাংলাদেশ সব সময় রক্ষা করবে। আমরা ভারতের সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করি। কামনা করি ভারতের উজ্জ্বলতর কল্যাণকর ভবিষ্যত। আমরা বর্তমান ভারত সরকারকে সগ্রামী অভিনন্দন জানাই। যে সমস্ত ভারতীয় বীর সেনানী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন যে সমস্ত জনতা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(সংগ্রামী বাংলা ৫ই পৌষ ১৩৭৮)
৮ই জানুয়ারি ১৯৭২