১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭০
পাকিস্তানে আসন্ন বৃহত্তর সংগ্রাম
পূর্ববাংলায় মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের প্রথম প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটে সাধারণ নির্বাচনে শতকরা ৭০টি ভােটে শতকরা ৯৯টি আসন লাভ করে সমস্ত পৃথিবীকে অবাক করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের জাতীয় কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে একদলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। যদি পাকিস্তানে সত্যিই গণতান্ত্রিক নীতি মানা হতাে, তবে এক বিচিত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারতাে। এতকাল পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিশেষ করে পশ্চিম পাঞ্জাবীরা পূর্ববাংলাকে দাবিয়ে এসেছে, এবারে জাতীয় অ্যাসেম্বলীতেই বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়াতে পশ্চিম পাকিস্তানকেই পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান দাবিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখতে পারে! যেন এবারে বাঙালির ভয়েই পশ্চিমীদের শঙ্কিত হতে হচ্ছে। একি বাঙালির জাগরণের পূর্বাভাস?
কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ মনে হচ্ছে না এবং বাঙালির দুঃখ ও অপমান শীঘ্র দূর হয়েও যাচ্ছে না বলে মনে হয়। আজ যারা নির্বাচনে জয়া হলেন, বস্তুত তাঁদের হাতে কোনই ক্ষমতা দেওয়া হবে না, পাকিস্তানি সংবিধান তৈরি হবার পূর্বে একটা অন্তবর্তী সরকার (interim govt) স্থাপন করতেও সামরিক শাসন দেবে। সামরিক শাসন চলছে, চলবে।
একশত বিশ দিনের মধ্যে যদি নির্বাচিত অ্যাসেম্বলী কোনাে সংবিধান রচনা করতে না পারে, তবে ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে এই অ্যাসেম্বলী নাকচ করে দেবেন। আবার যেমন তেমন একটা সংবিধান রচনা করলেও চলবে না , যদি ইয়াহিয়া খানের অভিরুচি সেই সংবিধান সন্তুষ্ট করতে না পারে, তাতেও সংবিধান বাতিল ও অ্যাসেম্বলী নাকচ হবেই এসব কথা স্পষ্ট করেই ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, এমন কোনাে সংবিধান তিনি মানতে রাজী নন, যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কিছুমাত্র ক্ষুন্ন হয়। তাই যদি হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি অথবা মুজিবর রহমানের ছয় দফার দাবির কোনই মূল্য থাকবে না।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের রাজনৈতিক হিসেবে সম্পূর্ণ বানচাল হয়ে গেছে সন্দেহ নেই। তিনি বিভিন্ন দলের মধ্যে (পাকিস্তানে ৪১ টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে) আসনগুলাে এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকবে আশা করেছিলেন, কেননা পাকিস্তানে দলাদলির বিচিত্র চিত্র দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান ছিল, এবং তাই তিনি আশা করেছিলেন যে দলগুলাে কখনাে ঐকমত হতে পারবেই না, একে ওকে প্রলােভন দেখিয়ে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যে গণতান্ত্রিক দলগুলাে সংবিধান রচনা করতে পারবে না এবং শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান নিজের মনে মনে যে সংবিধান এঁটে রেখেছেন, তাই চাপয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু পুরানাে রাজনৈতিক দল, নেতা ও গােষ্ঠীগুলাে এবারে এক রাজনৈতিক বন্যায় একেবারে ধুয়ে মুছে গেছে। তাদের এতদিন বেঁচে থাকাও সম্ভব ছিল না, একমাত্র সাধারণ নির্বাচন হয়নি, হতাে না বলেই এঁরা রাজনৈতিক আসর আঁকিয়ে থাকতাে। এসব রাবিশ এখন একদম সাফ। রাজনৈতিক দিক থেকে পুরানাে নেতৃত্বের উপর নির্ভর করার এতটুকু অবলম্বন আজ আর ইয়াহিয়া খানের হাতে নেই।
তাই বলে ইয়াহিয়া খান সবরকম রাজনৈতিক সমর্থন হারিয়ে ফেলেছেন তা মনে করার কারণ নেই। জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ৮১ টি আসন দখল করে যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন, সেটি ইয়াহিয়া খান তত ভয় করবেন না, বরং এটাই তার একমাত্র রাজনৈতিক ভরসা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও ভূট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে নওজোয়ানদের অগ্রগতি ও নেতৃত্ব বােঝায়, যদিও ভূট্টোর রাজনৈতিক মতবাদ সমাজতন্ত্র ও চীনাঘেঁষা বলে বর্ণিত হচ্ছে, যদিও ভূট্টোর মুখ দিয়ে অনবরত অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে সকল প্রকার কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে, তথাপি ভূট্টোর জেহাদী ঘােষণাগুলাের মধ্যে একটা “ইতিগজ” জাতীয় সুর বাজে। ভূট্টো চরম বামপন্থী, কিন্তু তার সমাজতন্ত্র ঐশ্লামিক, এবং এই ঐস্লামিক বিশেষণটির বিশেষ তাৎপর্য হলাে ভারতবিদ্বেষ। তিনি অনন্ত কাল ধরে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা চালিয়ে যেতে চান, তিনি তাসখন্দ চুক্তি কখনও মানেন না। ভারত বিদ্বেষই হলাে পাকিস্তান দর্শনের মূলতত্ত্ব। এবং যদি এমন কোনাে রাজনীতি পাকিস্তানে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যাতে ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপিত হতে পারে, তবে পাকিস্তানের মূল দার্শনিক আধারটাই নষ্ট হয়ে যায়। ইয়াহিয়া খান ভূট্টোর এই ভারত বিদ্বেষটাই অত্যন্ত গ্রহণযােগ্য সারবস্তু হিসেবে গ্রহণ করবেন, তাঁর অগ্নিগর্ভ সমাজতান্ত্রিক বুলিগুলাে যদি পাকিস্তানের যুব সম্প্রদায়কে ভূট্টোর করতলে আবদ্ধ করে রাখতে পারে, তবে ফন হিন্ডেনবার্গের হিটলারকে গ্রহণ করার মতাে ভূট্টোকেই রাজপাটে বসাতে ইয়াহিয়া খানের কি আপত্তি থাকতে পারে? আর অনন্তকাল ধরে যদি ভারতের সঙ্গে লড়াই করার নীতিই ভূট্টো নেন, তবে সে লড়াইয়ের জন্য একান্ত প্রয়ােজনীয় সামরিক বাহিনীকে নিশ্চয়ই ভূট্টো সাহেবকে মেনে নিতে হবে, তাতে সামরিক গােষ্ঠী তথা আয়ুব-ইয়াহিয়া গােষ্ঠী নিজেদের বিপন্ন বােধ করবেন কেন?
গত পনের বছর ধরে পাকিস্তানি রাজনীতির বিশেষ করে পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং আজও দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে। এই নির্বাচনের মূল সমস্যাও ছিল পাকিস্তানের অন্তর্গত জাতিগােষ্ঠির বিশেষ করে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের ক্রমবর্ধমান দাবির প্রশ্ন। যদি পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মতামতের বিন্দুমাত্র মূল্যও পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক গােষ্ঠি এতটুকুও দেয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের দাবিকে আজ আর অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় গণপরিষদে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় (simple majority) সাংবিধানিক এই মৌলিক অধিকার কিছুতেই স্বীকার করা হবে , দুই তৃতীয়াংশ ভােট না হলে সংবিধান পাস হবে না বলে ঘােষণা হবেই, এবং মুজিবর রহমান দুই তৃতীয়াংশ ভােট একমাত্র বাঙালির জোরে পেতেই পারেন না—কাজেই বাঙালির পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন যে তিমিরে সে তিমিরেই থেকে গেল। ভূট্টোর পিপলস পার্টি এই বাঙালি জাগরণের বিরুদ্ধে একটা মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। উভয় পাকিস্তানের মধ্যে কোনাে রাজনৈতিক সেতু আর রইল না, কেননা পূর্ববাংলার আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে একটিও আসন পায়নি, পিপলস পার্টিও পূর্ববাংলায় কোনাে আসন পায়নি, নিখিল পাকিস্তানি কোনাে রাজনৈতিক দল কেন্দ্রীয় গণপরিষদে একটিও আসন পায়নি সর্ব পাকিস্তানি কোনাে সম্বন্ধ আজ আর পাকিস্তানেই নেই দেশটি যে আসলে দুটি দেশ একদেশ, নয়, একথাও আজ রাজনৈতিক দিক থেকে প্রমাণিত হয়ে গেল। তাই বলে দুটি দেশ সামরিক শাসন বা ভূট্টো নেতৃত্ব কখনই স্বীকার করবে না। তারা সম্মিলিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের উপরে আক্রমণ চালাবে, ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তি দিয়ে, আর ভূট্টো সাহেব রাজনৈতিক বাধা সৃষ্টি করে গণপরিষদে।
অতএব পূর্ববাংলার সংগ্রাম জয়ী হলাে না, তাকে বরং বৃহত্তম সংগ্রামের মুখােমুখি আসতে হবে। সে সংগ্রাম কতটুকু বা কতখানি পর্যন্ত আইনসঙ্গত ও নিরস্ত্র সংগ্রামে সীমাবদ্ধ থাকতে পারবে সেটা কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে।
পূর্ব পাকিস্তানে এই আসন্ন সগ্রামে সব বাঙালিরা এক হয়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা, এটাও বিচার্য বিষয়। মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ পার্টি এই নির্বাচন বয়কট করেন, বয়কট করে নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা হয়তাে আত্মহত্যা করে বসেছেন বলে এখন ভয় হচ্ছে। তাই মৌলানা ভাসানী ঘােষণা করেছেন যে এই নির্বাচনে নাকি তার মতবাদই জয়ী হয়েছে!! তার ইচ্ছানুযায়ীই নাকি পূর্ব পাকিস্তানে কেবল পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নয়, এমনকি পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে জনগণ রায় দিয়েছেন। হঠাৎ তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার দাবি উপস্থিত করেছেন, এমনকি পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা যদি ভারতের অধীনতা থেকে নিজেদের মুক্ত করে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে চান, তবে তিনি তাদের সাদরে কোল দেবেন! এতদিন পর্যন্ত বাঙালি-স্বাধীনতার কথা আমরা ন্যাপের মুখ থেকে কোনােদিন শুনিনি! বরং আওয়ামী লীগের বাঙালিয়ানাকে তিনি পিও করতেন তিনি সমস্ত পাকিস্তানের জনগণের ঐক্যের ভিত্তিতেই নিখিল পাকিস্তানি জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলতেন। হঠাৎ তার মতটা এমন বদলে গেল কেন? এতাে ভালােও ভাল নয়। মুজিবর রহমানের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তিনি এখন কোন্ রাজনৈতিক সগ্রামের চাল দিতে চান, এ সন্দেহ আসা স্বাভাবিক। তাছাড়া এই সেদিনও তিনি ঘােষণা করেছেন ভারতের সঙ্গে অবিরাম সগ্রাম ছাড়া কাশ্মীর-সমস্যা মিটতে পারে না, ভারতের সঙ্গে সমঝােতা বা নিগােসিয়েশানের কোনাে ক্ষেত্র নেই। তিনি বলেছেন “আমাদের সকলকেই এখন মদ-ই মুজাহিড় হতে হবে” (ডন পত্রিকা – ২২-১০-৭০)। তাঁর ভারত বিদ্বেষ পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের প্রতি ভারতের অত্যাচারদৃষ্টে, এমন মনে করার কোনাে কারণ নেই, কাজেই হঠাৎ দুই বাংলাকে এক করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গড়ার ডাকটা উভয় বাংলাতেই একটি হঠকারী ও প্ররােচনামূলক চাল বলে ধরে নেবে। নিজের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সহসা বিলীয়মান হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি হয়তাে এই আপাতবিপ্লববাদী ডাক দিয়ে বসেছেন। পূর্ব বাংলার এই নবজাগরণকে ভিতর থেকে চুরমার করে দেবার সর্বপ্রকার ফাঁদ এড়িয়ে চলতে পারবে কিনা বাঙালিরা এতটা রাজনৈতিক সাবালকত্ব বা maturity তাদের এসেছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। কেননা আজ যেটা দরকার সে হলাে ভারত তথা পশ্চিম বাংলার সঙ্গে পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার সহজ স্বাভাবিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। হাতের পাখিটা বনের দুটি পাখির চেয়ে ঢের বেশি গ্রহণীয়- এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা উভয় বাংলার বাঙালিদেরই থাকা উচিত। অবশ্য পূর্ব বাংলার বাঙালিদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে যে সংগ্রাম আসন্ন, তাতে মৌলানা ভাসানীর দল যদি মুজিবর রহমানের দলের সঙ্গে সততার সঙ্গে হাত মেলায়, তাতে ভাসানির দল নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যতটা ক্ষগ্রিস্ত হয়েছেন তাতে কিছু আসে যায় না। কেননা সেদিন যে সগ্রাম শুরু হবে তাতে মুজিবর সাহেবের হাতে যে কয়জন নির্বাচিত সদস্য আছেন তাদের দ্বারাই সে সগ্রাম হবে না, সেই ৯৯% নির্বাচিত সদস্যদের পিছনে যে ৭৫% জনমত ছিল সেই জনশক্তিকে আরও দৃঢ় আরও প্রচণ্ড ও অপরাজেয় করে তুলতে নিশ্চয়ই ভাসানি সাহেব সাহায্য করতে পারেন চাষি মজুর মধ্যবিত্ত সবাইকে এক হয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারেন। পূর্ব বাংলার এই স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামটাই আসলে সত্যিকার সগ্রাম, দুই বাংলাকে এক করাও নয় অথবা ভারত বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েও নয়!
সূত্র: কম্পাস