১৯৬৯, ১লা মার্চ
পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক বিপ্লব
পশ্চিমবঙ্গে আমরা যখন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মত্ত ছিলাম, পাকিস্তানে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে তখন শুরু হয়ে গেছে গণতন্ত্রের জন্য বিপ্লব। আমাদের নির্বাচনী ডামাডােল ও ঢক্কা নিনাদকে ঢাকার উদাত্ত ডাক নিপ্ৰভ করে দেবার কথা। প্রতিদিন সেখানে পুলিশ ও মিলিটারির গুলিগােলা, নিহত শতাধিক, আহত হয়েছেন হাজারে হাজারে। কেমন করে মৃত্যু বরণ করতে হয় তার বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছেন তারা। এখনও জনতা অস্ত্র হাতে নেয়নি, কিন্তু ক্রমশই তাদের সে দ্বিধা ও সংকোচ হয়তাে কেটে যাচ্ছে। তবু একথা স্বীকার করতেই হবে, হিংসাটা এক পক্ষেরই, সামরিক বর্বরতাই সেখানে আক্রমণকারী। একতরফা মার খেতে হয়তাে তারা আজ রাজী নন। প্রতিক্রিয়াশীলদের জীবন ও ঘরবাড়ি ক্রমশই বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রচারটা অবশ্য সরকারি রেডিও থেকেই দেওয়া, ধরেই নেওয়া যায় তা অভিসন্ধি ও নিন্দামূলক উদ্দেশ্যজাত। যেমন, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের জেলের মধ্যে গুলি করে মেরে, তারা পালাবার চেষ্টা করছিলেন বলে যে প্রচারটি পাক বেতার থেকে করা হয়েছে, তা মে বিশ্বাসযােগ্য নয়, এটা ধরেই নেওয়া যায়। আয়ুবপন্থীদের সব বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে প্রচার হচ্ছে, এসব সংবাদ কিঞ্চিৎ লবণ সংযােগে গ্রহণ করা উচিত।
কিন্তু হাজারে হাজারে নয়, লক্ষে লক্ষে নরনারীরা ক্রমশ মৃত্যুর ভয় দূর করে ফেলেছেন এ সংবাদ আজ আর পাকিস্তানি কারাগারের দেশ থেকেও চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কী অদ্ভুত অসম্ভব জনসমাবেশ হচ্ছে, সকল প্রকার বাধানিষেধ ভঙ্গ করে তার একটা চিত্র আমরা দিলাম। আইনের ভাষায় বলে, কথা, সাক্ষ্য, দলিল সব মিথ্যা হতে পারে আলােক চিত্র মিথ্যা কথা বলে না। এই ছবিটা থেকেই সবাই বুঝতে পারবেন, পাকিস্তানি জনসমুদ্রে কী উত্তাল ঝড় ও বান দেখা দিয়েছে। এই বন্যায় আয়ুবশাহী ভেসে যাচ্ছে, যাচ্ছে, গেল বলে।
কেবল পূর্ব পাকিস্তান থেকে নয়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও আয়ুবশাহী আজ অন্তগামী। পূর্ব দিগন্ত থেকে যে বিদ্রোহের সূর্য উদয় হয়েছিল তা পশ্চিম দিগন্তের আকাশ অগ্নিময় করে তুলেছে।
প্রতিক্রিয়াশীলেরা জট পাকাবার চেষ্টা এখনও করছে। অৰ্দ্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ বলে পূর্বপাকিস্তানকে বাদ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানটুকু অন্তত যাতে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে রাখা যায় তার জন্য চেষ্টা আছে। আর আছে হঠাৎ এমন কয়েকজন “গণতান্ত্রিক নেতা” দাঁড় করিয়ে দেওয়া, যারা মুখে খুবই বামপন্থী, প্রায় কমরেড তাদের সাহায্যেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে এক সূত্রে বেঁধে রাখার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে আর এক ধরনের প্রতিক্রিয়ার জোট সৃষ্টি করা। সেই উদ্দেশ্যেই আয়ুবখানের শেষ চেষ্টা সবাইকে নিয়ে বসবার বা সম্মেলনে করার চেষ্টা। “ডাক” নামক ৮টি দলের জোটে সবাই প্রগতিশীল নন যদি তাতেও কোনাে ভাঙন ধরাতে পারেন গােলটেবিলের বৈঠকে ও অন্তরালে সে চেষ্টাও চলছে। নতুন করে সামরিক বা মার্শাল শাসনের আর কোনাে নতুন হাতিয়ার আয়ুব খানেরই নেই। তাঁর শক্তির সবটাই দেখানাে হয়ে গেছে, এখন বাকী আছে চাতুরী।
শেখ মুজিবর রহমানকেও নাকি প্যারােলে মুক্তি দিয়ে ঐ গােলটেবিলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মনে পড়ে একদিন গান্ধীজী বিলেতের গােলটেবিলে গিয়েছিলেন, গিয়ে ঠকেছিলেন আন্দোলনকে স্থগিত রাখতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী শেষ পর্যন্ত বােকা বনে ছিলেন। শূন্য হস্তে ফিরে এসে গান্ধীজীকে সােজা আবার জেলে ঢুকতে হয়েছিল। আমরা আশা করি শেখ মুজিবরের সে অবস্থা হবে না। হয়তাে পাকিস্তানের অবস্থা ঠিক অনুরূপ নয়। সংগ্রামটা আজ ক্রমবর্ধমান ও ক্ৰমবেগবান দিকে দিকে তা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে গ্রামে শহরে, বন্দরে, স্কুলে, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও অবাধ গুলিগােলা চলেছে, অকাতরে শহীদ হচ্ছেন ছাত্র, শিক্ষক, মজুর, কৃষক সবাই। এই বেগ যদি থাকে, তবে মুজিবর রহমানের হাল গান্ধীজীর মতাে না-ও হতে পারে।
আরও মনে রাখতে হবে কমরেড” ভূট্টোর জিগির হাজার বছর ধরে লড়ে যাবার কথা ভারতের সঙ্গে। ভূট্টোর কমরেডীপনা অবশ্য চীনাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার খুঁটি থেকেই উদ্ভূত। আসলে ভূট্টো কমরেড কিছু নয়। তেমন কমরেড আয়ুব খানও ছিলেন। আরও অনেকেই আছেন, যাদের কমরেডী পােশাকটা ফেলে দিতে মুহুর্তের সময় লাগে না। পাকিস্তান রেডিও এখনও প্রতিদিন ভারত বিদ্বেষ আর কাশ্মীর উদ্ধার নিয়েই ব্যস্ত আছে। দ্রলােকদের বলি, এখন নিজেদের হাতে যে টুকু পাকিস্তান আছে সে টুকুই দেশের লােকদের হাত থেকে রক্ষা করুন! ভারতস্থ কাশ্মীরের অংশটুকুই কি এখন আপনাদের প্রধান মাথা ব্যথার ব্যাপার? এই সংকীর্ণ বুদ্ধির নিরেট প্রচারকরা আশা করেন যে যদি কোনােমতে আবার হিন্দুমুসলমান দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেওয়া যায়, বা কাশ্মীর নিয়ে একটা সংঘর্ষ ঘটানাে যায়, তবেই আয়ুবশাহী এবারেও রক্ষা পেতে পারেন, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানকে হাত ছাড়া করতে হয় না! এই হাতিয়ারটা যে ভোতা হয়ে গেছে, কোনাে কাজ দিচ্ছে না, সেটা বোেঝবার মতাে বুদ্ধি আর তাদের মগজে নেই।
সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী বিদ্রোহাত্মক আন্দোলন সৃষ্টি হলেও, সব বিদ্রোহীর উদ্দেশ্য এক নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু কিছু “বিদ্রোহী” বিশ্বাসঘাতকতা করতেও পারেন কিন্তু পাখতুনী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচিরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে, যাদের ফেরানাে সম্ভব হবে না। সব চেয়ে বড় নির্ভরযােগ্য বিদ্রোহী বা গণতন্ত্রের ঘাঁটি হলাে পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনতা ও ছাত্র শক্তিকে আজ আর ভুল বােঝাবার উপায় নেই। প্রতিদিন শহীদের রক্তের অক্ষরে তা সর্বত্র একটা জাতীয় বৈপ্লবিক প্রতিজ্ঞায় পরিণত হচ্ছে। এই আগুনে দুর্বল নেতৃত্ব আর কোনাে ঠাই পাবে বলে মনে হয় না।
পূর্ব দিগন্তে এই যে বিপ্লবের শিখা, এর আভা পশ্চিমবঙ্গে ও অন্যত্রও পড়বে। সর্বত্রই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম। সকল গণতান্ত্রিক জনমানুষের স্বার্থ আজ এক। পূর্ব ও পশ্চিমের এই সংগ্রাম পরস্পরের পরিপূরক। এই সংগ্রামেই উভয় দেশের সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডুকতা, ও প্রতিক্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড তৈরি হচ্ছে। ভারতবর্ষেও সে সব শক্তি গণতন্ত্রের গলাটিপে মেরে সামরিক শাসন কায়েম করার স্বপ্ন দেখতেন, তারা পাকিস্তানের আয়ুবশাহীর এই দশা দেখে ভয় পাবেন সন্দেহ নেই। এই অর্থে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের এই সংগ্রাম ভারতবর্ষেও প্রগতিশীল ভারতবাসীদেরও সাহায্য করছে। যারা আজ ওদেশে শহীদ, তারা আমাদেরও শহীদ।
এমন দিনে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছু অতিরিক্ত সচেতন হওয়া দরকার। ভারত সরকারের বৈদেশিক নীতি কিছু আছে বলে মনে হয় না, একমাত্র চুপচাপ থাকা ও চোখ বুজে থাকা ছাড়া। ভারত সরকার নিশ্চয়ই পাকিস্তানি রাজনীতিতে নাক গলাতে যাবেন না, যাওয়া ঠিক না। কিন্তু আজ একথা পরিষ্কার ভাষায় বারবার বলা দরকার যে ভারত পাকিস্তানের কোনাে ক্ষতি করতে চায় না, এক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও বেদখল করতে চায় না। পাকিস্তানিরা সুখী সমৃদ্ধ প্রগতিশীল সরকার গঠন করুন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাধিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রস্তুত হােন। স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য কমন মারকেট ইত্যাদির প্রস্তাব প্রস্তুত করুন। স্বাধীন পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য ভারতকে সর্ববিধ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে প্রস্তুত হােন।
কিন্তু ভারত সরকার কি সত্যিই প্রগতিশীল বিপ্লবী পাকিস্তানকে ভাল চক্ষে দেখবেন? পূর্ব পাকিস্তানের মতাে ভারতীয় রাজ্যগুলােও যদি অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দাবি করে বা স্বরাজ’ দাবি করে (গান্ধীজীর অর্থেও) তাকি তারা মেনে নেবেন? ভারত সরকারকে তার নিজের মন পরিষ্কার করতে হবে। আয়ুবশাহী রাওয়ালপিণ্ডির কলােনিয়ালিজমের সঙ্গে লড়তে হলে একচেটিয়া পুজির ও বিদেশী পুজির দিল্লী মার্কা কলােনিয়ালিজম এর ভাব ও কর্মধারা থেকে ভারত সরকারকেও মুক্ত হতে হয়। ভারতীয় পাটিগুলাের চিন্তা চেতনাকেও আজ পরিষ্কৃত করার দরকার আছে। কোনাে প্রকার গােজামিলকে বিপ্লবী পাকিস্তানও সন্দেহ না করে পারবে না। অতএব ভারতীয় রাষ্ট্র ও ভারতীয় রাজনৈতিক পার্টিগুলাে ও ভারতীয় জনসাধারণকেও আজ পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে তারা নতুন পাকিস্তান সম্বন্ধে সত্যিই কী করবেন। উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য, উভয় দেশের নদী নালা শাসনের ক্ষেত্রে সংযুক্ত পরিকল্পনা, উভয় দেশের মধ্যে মুক্ত যাতায়াত ব্যবস্থা, কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে নতুন করে মীমাংসার আশ্বাস দান, পাক-ভারত কনফেডারেশন ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপারে নতুন করে এবং স্পষ্ট করে উভয় দেশেই সুস্থ জনমত গঠন করার দায়িত্ব আছে আজ আমাদের সবার।
পান্নালাল দাশগুপ্ত
সূত্র: কম্পাস