১৯৬৬, ১৯শে ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমাদের প্রগতি
২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে এবং পাক-ভারতীয় রাজনীতিতেও একটি বিশেষ স্মরণীয় দিন। ১৪ বছর আগে ১৯৫২ সালে এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহরে বরকত, সালাম ও রফিক নামে তিনজন বীর ছাত্র পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার জন্য মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশের গুলিতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে শহীদানের গৌরব অর্জন করেন। এই দিনটি পূর্ব বাংলায় ছাত্র, যুব ও গণতান্ত্রিক কর্মীদের দ্বারা অসামান্য উৎসাহ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়। আমরাও এই দিনটিকে সমান বরণীয় জ্ঞানে গ্রহণ করতে পারি। এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য কী এবং গুরুত্ব এত বেশি কেন, আমাদেরও তা বােঝা উচিত।
অত্যন্ত সংক্ষেপে বললেও একথা বলতে হয় যে, পূর্ব বাংলায় জাতীয়তা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্য যে সংগ্রাম আজও অব্যাহত রয়েছে তার উৎস ও প্রেরণা ১৯৫২-র স্মরণীয় ২১শে ফেব্রুয়ারি ও এই দিনের ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন সাহিত্যিক ঝগড়া নয়, রাজনৈতিক সংগ্রাম। পূর্ব-বাংলার মানুষের জাতীয়তার ভিত্তি কী, পূর্ব-পাকিস্তানে মানুষের অধিকার রক্ষা পাবে কি পাবে না, এইসব মূল প্রশ্নই ভাষা- আন্দোলনের ফলে স্পষ্ট হয়ে যায়। স্পষ্ট হয় যে, মানুষের জাতীয় সত্তা ও সাম্প্রদায়িক পরিচয় এক নয়, বাংলাদেশের মানুষ শুধু মুসলিম ও হিন্দু হিসেবে বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়, তারা বাঙালি হিসেবে একই জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতীয়তার যে সাম্প্রদায়িক অপব্যাখ্যা দেশবিভাগের আগে-পরে প্রবলভাবে চালু হয়েছিল, ভাষা আন্দোলন তার প্রভাব খর্ব করে, তার সম্প্রসারণ রােধ করে। একই জন্মভূমি ও ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলায় গণতান্ত্রিক নীতির বিকাশ ঘটে এবং মানবিক অধিকারের সংগ্রাম বহুগুণ শক্তিশালী হয়। সাম্প্রদায়িকতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে পূর্বে বা পশ্চিমে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন অসম্ভব, ছাত্র বা যুব আন্দোলনও সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের সাফল্য ও শক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে ভেতর থেকে দমন করার ফলে, অন্য সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ ও অগ্রগতি সম্ভব করে তুলেছিল। এই কারণেই ভাষা আন্দোলনে যারা অগ্রবর্তী ভূমিকা নিয়েছিলেন অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তাদেরই পুরােভাগে দেখা গিয়েছিল। ১৯৫৪তে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগের চরম পরাজয় সম্ভব করেছিল এই গণতান্ত্রিক শক্তি এবং তার ফলে সারা পাকিস্তানেই রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়েছিল। এই কারণেই আমরা উল্লেখ করছি যে ২১শে ফেব্রুয়ারি পাক-ভারত রাজনীতিতেও একটি বিশেষ স্মরণীয় দিন।
কিন্তু এই দিনটিকে স্মরণ করার সঙ্গে এ কথাও মনে আসে যে ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রতিজ্ঞা এখনও পূর্ণ হয়নি। বাংলা ভাষা পাকিস্তানে সরকারি স্তরে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে কিন্তু ভাষা আন্দোলন যে গণতান্ত্রিক শক্তিকে জন্ম দিয়েছিল সেই শক্তি পূর্ব বাংলায় এখনও জয়ী হয়নি। এখনও স্বৈরতন্ত্রের ক্ষমতা সে কেড়ে নিতে পারেনি। ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামােয় সাম্প্রদায়িকতাকে যেভাবে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতাহীন হয়ে থাকার ফলে গণতান্ত্রিক শক্তি এখনও তাকে স্থানচ্যুত করতে পারছে না। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এই প্রশ্নও করতে হবে যে, চৌদ্দ বছর চলে যাবার পরেও ভাষা আন্দোলনের মৌলিক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এখনও অপূর্ণ রয়ে গেল কেন?
ভাষা আন্দোলনের সমস্ত ঝুঁকি নিয়েছিল পূর্ব বাংলার ছাত্রেরা কিন্তু তার ওপরের স্তরে নেতা হিসেবে ছিলেন পুরনাে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নেতারা। পৃথিবীর কোথাও ছাত্রেরা কোনাে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্ৰেণী নয়, জাতীয় অর্থনৈতিক কাঠামোেয় তাদের কোনাে স্থান থাকে না। ছাত্রেরা একটি অগ্রসর অংশ (radical section) বৈপ্লবিক শ্রেণী নয়। তারা তাই একটা আন্দোলন শুরু করতে পারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব সেই আন্দোলনকে তার পূর্ণ পরিণতির পথে নিয়ে যাওয়া তাদের সাধ্যাতীত। সেই পরিণতি দিতে পারে শুধু এক বলিষ্ঠ বৈপ্লবিক শ্রেণীর নেতৃত্ব, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে যাদের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, যাদের বিরােধিতা রাষ্ট্র কাঠামােকে অচল করে দিতে পারে। পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও তার নেতারা এই বৈপ্লবিক নেতৃত্ব দিতে পারেননি। নানা কারণে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। অথচ এখনও পূর্ব বাংলায় নতুন কোনাে জাতীয় বৈপ্লবিক সংগঠন ও নেতৃত্ব শক্তি অর্জন করতে পারেনি। পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব প্রাথমিক স্তরে সাম্প্রদায়িকতার আওতাতেই সম্ভব হয়েছিল। এখনও জাতীয়তাকে পুরােপুরি মেনে নেওয়ার পথে অনেক বাধা আছে তাদের। আর সেই জন্যই স্বৈরতন্ত্রকে আহত করার ইচ্ছে থাকলেও আঘাত করতে তঁারা সঙ্কুচিত। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব পাকিস্তানের বর্তমান কাঠামাের সঙ্গে অনেকটা জড়িত, যদিও এই বর্তমান কাঠামােই তাদের অবস্থা দিন দিন দুর্বিষহ করে তুলছে।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী সংকটের কারণ এইটাই মনে হয়। যতদিন না অন্য কোনাে শ্ৰেণী এগিয়ে আসে অথবা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের দ্বিধাগ্রস্ততা কাটিয়ে উঠতে পারেন ততদিন কোনাে সমাধান সম্ভবও নয়।
সূত্র: কম্পাস