You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.04.08 | সম্পাদকীয় | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

৪র্থ সংখ্যা ১৮ই এপ্রিল ১৯৬৪
সম্পাদকীয়

ভারতের মুসলমানদের দ্বিজাতিতত্তের জতুগৃহ থেকে বেরিয়ে আসবার একটিই মাত্র পথ আছে। সে হলাে পাকিস্তানে এক বিপ্লব। পাকিস্তান একটি আলাদা দেশ থাকে থাকুক, পাকিস্তান পূর্ব ও পশ্চিমে আলাদা দুটি দেশ হয়ে যাক আর নাই যাক, সেটা সব চেয়ে বড় কথা নয়, বড় কথা হলাে পাকিস্তান থেকে মােল্লাতন্ত্র হটাতে হবে, তাকে ঐশ্নমিক রাষ্ট্র হলে চলবে না, যেমন ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানালে চলবে না। উভয় দেশকেই গণতান্ত্রিক দেশ করতে হবে, তবেই পাক ভারত উপমহাদেশে আবার শান্তি, সহযােগিতা ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। এই সঞ্জাম কেবল ভারতেই বর্তমান তা নয়, পাকিস্তানেও এই গণআন্দোলন দিন দিন প্রখর হয়ে উঠেছে। ভারতীয় মুসলমানেরা পাঁচ কোটি হয়েও কি নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা নিয়েই থাকবেন?
দ্বিজাতি তত্ত্বের মােহ থেকে মুক্ত হন মুসলমান ভায়েরা। দেখবেন সমস্ত ভয় সহসা কোথায় দুঃস্বপ্নের মতাে উবে গেছে। নইলে এই পাপ চক্র থেকে উদ্ধার নেই। মনে করেছেন কি কাশ্মীর পাকিস্তানে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে, শান্তি দেখা দেবে? জম্মু ও কাশ্মীরের ২৪ লক্ষ মুসলমান যদি পাকিস্তানে যায়, তাতে আসামের ৩০ লক্ষ, পশ্চিম বাংলার ৭০ লক্ষ, বিহারের ৬০ লক্ষ, উত্তর প্রদেশের ১ কোটি, কেরালার ৩০ লক্ষ মুসলমানের মুক্তি কোথায়? তাদের প্রতি সন্দেহ কি তাতে আরও বেড়ে যাবে না, মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস কি আরও গভীর হয়ে উঠবে না? সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কি আরও সঙ্কটজনক হয়ে উঠবে না? পাকিস্তানের সঙ্গে সংলগ্ন বলে কাশ্মীরের মুসলমানদের যদি পাকিস্তানেই যেতে হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংলগ্ন বলে অসমীয়া ও পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির মুসলমান অঞ্চলগুলােকেও তাে পূর্ব পাকিস্তানকেই দিয়ে দিতে হয়? এর শেষ কোথায়? যুদ্ধে যুদ্ধে কি পাকিস্তান রক্ষা পাবে যার দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান হাজার মাইল? যুদ্ধে কি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আরও বিপন্ন হবে না?
বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম ক্রমশ স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হতে বাধ্য। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যে বিরােধ তা ক্রমশ বাড়বে বই কমবে না, যতক্ষণ না আয়ুবশাহী শেষ হয় এবং একটা সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ব্যবস্থা জন্ম নেয়। এই সংগ্রামে আপনাদের ভারতীয় মুসলমানদের বক্তব্য কী? আপনারা নীরব কেন, নিষ্ক্রিয় কেন? যদি পূর্ব পাকিস্তানে একটি বিপ্লব হয়, তবে তাকে আপনারা কী চোখে দেখবেন? তাকে কি সমর্থন করবেন, সাহায্য করবেন, না আয়ুব শাহীর হয়ে তাকে পরাজিত করবার চেষ্টা করবেন? এই মৌলিক অথচ বাস্তব প্রশ্নের উত্তরের জন্য আপনারা প্রস্তুত হােন। আপনারা কি মৌলানা ভাসানী, মুজিবর রহমানকে সমর্থন করেন, না সবুর খান, মুনেম খানদের সমর্থন করেন? আপনাদের বলিষ্ঠ চিন্তা, চেতনা ও কর্মপন্থা কোথায়? আপনারা যদি এগিয়ে এসে এই প্রগতিমূলক সগ্রামকে সাহায্য করেন তবে ও দেশে তাদের কাজ অনেক সহজ হয়। পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব বাংলারূপে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হতে চায়। তাতে আপনাদের সাহায্য করা উচিত, কেননা ঐ পথেই জতুগৃহ থেকে বেরিয়ে আসার পথ আছে ঐ পথেই মুসলমানদের উপর হিন্দুদের সন্দেহ দূর হবার পথ রয়েছে, ঐ পথেই আপনাদের ভারতের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করার উপায় রয়েছে।
পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম বাংলার সঙ্গে মিলিত করার কথাই এটা নয়। স্বাধীন গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা যদি পূর্ব গগনে উঠে পড়ে তবে সমস্ত পাক ভারত উপমহাদেশ গােটাটাই সেই আলােতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। অন্ধকারে এই হানাহানি খুননাখুনি করে আজ আমরা যে নরক সৃষ্টি করে বসে আছি, সেখানে দুর্যোগপূর্ণ রাত্রি শেষে মানবতার মহান সূর্যোদয় দেখা দেবে। এটা স্বপ্ন নয়, এইটাই সত্য। এই সত্যকে কায়েম করার জন্য প্রধান ভূমিকা আপনাদের ভারতীয় মুসলমানদের। এই পথে অগ্রসর হলে ভারতের আপামর জনসাধারণের ও সমস্ত প্রগতিশীল দল ও লােকদের অকুণ্ঠ সমর্থন পাবেন আপনারা। ভারতের রাজনৈতিক জীবনে একটা মহান অংশ নিতে পারবেন। এতে ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশ পায় না। তুরস্ক, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, আলজিরিয়া প্রভৃতি সকল মুসলমান দেশগুলাে যেপথ ধরেছে, সেই পথই ধরা হবে। মুসলমানকে রক্ষা করা, উন্নত করা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র জ্ঞান বিজ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়, পরজাতি বিদ্বেষ ও মােগ্লাগিরি দিয়ে মুসলমানকে রক্ষা করা যায় না এবং ইসলামকেও রক্ষা করা যায় না। যেদিন থেকে ইসলাম মােল্লাদের হাতে পড়েছিল, সেদিন থেকে মুসলমানেরা হেরে যেতে লাগলাে সকল জাতির কাছে, ইয়ােরােপের কাছে। পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সামনে তাই একটা মহান কর্তব্য বর্তমান। একশত বছরের পশ্চাদগামিতাকে অতিক্রম করার জন্য তাই প্রতিটি মুসলমান মুলুকে বিপ্লবের অগ্নি জ্বলছে, আপনারাও তাতে যােগ দিন। পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে অন্ধকার দূর হােক। দুই দেশ থেকেই সাম্রাজ্যবাদের খেলা দূর হােক, আমরা সত্যি সত্যিই মুক্ত হই।

সূত্র: কম্পাস