You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা স্বাধীন বাঙলার রাজধানী হচ্ছে পরাজিত পাক সৈন্যরা চট্টগ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে

বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ের তরঙ্গে। পাঁচ দিনের অসম যুদ্ধের পর মঙ্গলবার ঢাকা মুক্ত। অসংখ্য পাকিস্তানী শহর নগর ছেড়েছে, ফেলে গেছে অসংখ্য মৃতদেহ। বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস হয়ে গেছে।
মুক্তিযােদ্ধারা নতুন কেন্দ্র বসিয়েছে। সেখান থেকে ঘােষণা করা হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক বাঙলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আসছে আর ইয়াহিয়ার সৈন্যরা নতুন রাজধানী খোঁজার ব্যর্থ আশায় অন্যত্র জায়গা খুঁজছে। এ সংবাদ ইউএনআই-এরও।
ক্রুদ্ধ জনতার আর দৃঢ়পণ মুক্তিবাহিনী পরিবেষ্টিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখনও লড়ছে মরিয়া হয়ে। চট্টগ্রামের পথে পথে হাতাহাতি লড়াই হচ্ছে প্রখ্যাত বন্দর শহরটি জ্বলছে লড়াই চলছে কুষ্টিয়া, খুলনা ও যশােহরেও। স্বাধীন বাঙলাদেশের সরকারের অস্থায়ী প্রধান জিয়া গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে ঘােষণা করেছেন অবশিষ্ট অঞ্চল দু একদিনের মধ্যে মুক্ত হবেই।
এদিকে পশ্চিম বাঙলার সীমান্ত নানা সূত্রে মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে সংবাদ আসছে লােক নয়, বুলেট চাই। চাই রক্ত, এটিএস, তুলাে, ব্যাণ্ডেজ, ইঞ্জেকশন দেওয়ার সিরিঞ্জ সীমান্তের কাছে পাঠিয়ে দিলেই ওরা সংগ্রহ করে নেবেন।
পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক পাকিস্তান রেডিও যখন বাঙলাদেশের জীবনমাত্র স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে দাবি করছিল তখনই স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঢাকার মুক্তি সংবাদ ঘােষণা করা হয়। ঐ বেতার কেন্দ্র ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম, নােয়াখালি, কুমিল্লা, যশাের, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহের সদরদপ্তর গুলি মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে দাবি করেছিল, ইউএনআই জানাচ্ছে বরিশাল, পাবনা এবং ফরিদপুর জেলা সম্পর্কে মুক্তি ফৌজের দপ্তর থেকে কোন সংবাদ দেওয়া হয় নি।
ঢাকা দখল
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ঘােষণা করেছে মঙ্গলবার ঢাকা মুক্তি যােদ্ধাদের দখলে এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকা থেকে পিছু হঠছে। সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা থেকে রাজধানী বাঙলাদেশের অন্যকোন অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
ঐ বেতার থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের শত্রুসৈন্যর পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বেতার কেন্দ্র থেকে এই প্রত্যয় ঘােষণা করা হয় “দু-একদিনের মধ্যে বাঙলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল মুক্ত হবে।”
বেতার থেকে বলা হয়, “আমরা আমাদের বেতার কেন্দ্র ঢাকার একটি নতুন কেন্দ্রে স্থানান্তর করেছি।”
ঢাকা ছাড়ার আগে সৈন্যরা বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দিয়ে যায়। অবশিষ্ট যন্ত্রপাতি মুক্তি ফৌজ ঢাকার মধ্যে অন্য এক কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
চট্টগ্রামে হাতাহাতি লড়াই
চট্টগ্রাম বন্দর শহরে মঙ্গলবার পাকিস্তানী সৈন্যরা মরিয়া হয়ে পুনর্দখলের জন্য লড়াই করেছে। প্রতিটি রাস্তা এখন রণক্ষেত্র। সৈন্যরা পিছু হটার সঙ্গে শহর জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তের ওপরে থেকে পাওয়া সংবাদ জানা গেছে এই শহরের বন্দর এবং নৌ ঘাটি দীর্ঘ দিনের জন্য অকেজো হয়ে থাকবে।
পশ্চিমের সৈন্যরা পিছু হঠছে। এ কথা বােঝা যায় স্থল, জল বিমান সব জায়গা থেকে তাদের নিরবিচ্ছিন্ন বােমাবর্ষণ ও কামান দাগার ঘটনা থােক। বােমা বর্ষণের যে সংবাদ এসেছে তার মধ্যে রাজশাহী অন্যতম।
মালদা থেকে এক সূত্রের সংবাদ হলাে রাজশাহীতে এতদসত্বেও ১০ হাজার পাকিস্তানী ফৌজ নিহত হয়েছে। এই জেলার নবাবগঞ্জ মুক্তি ফৌজ দখল করেছে।
কুমিল্লা থেকে সিলেট
মঙ্গলবার সকালে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘােষণা করা হয় কুমিল্লা থেকে সিলেট পর্যন্ত বিস্তার অঞ্চল মুক্তি যােদ্ধাদের দখলে। এই সব অঞ্চলে এখন স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকা উড়ছে। ঐ সংবাদে দাবি করা হয় একজন কর্নেল, দুজন মেজর এবং একজন লেফটেন্যান্টকে মুক্তি ফৌজ বন্দী করেছে।
কুমিল্লা অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার মেজর খালিফ (খালেদ] মুতারাক (মােশাররফ] সমস্ত ই পি আর বি আর আনসার এবং পুলিশকে তাদের পরিচয় পত্র সমেত কুমিল্লায় হাজিরা দিতে বলেছেন।
বিগত ২৪ ঘণ্টায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা এখন জনতার ওপর গ্রেনেড ছুড়ছে। ভােলায় ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হচ্ছে তবে মুক্তিবাহিনী তার প্রতিরােধ করছেন।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে যে মুক্তিবাহিনী সােমবার যাত্রা করেছিল তারা মঙ্গরবার সকালে ঢাকা থেকে ১৬ কিলােমিটার দূরে জয়দেবপুর পৌঁছেছে বলে বাঙলা বেতার জানিয়েছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যযাদ্ধারা কুমিল্লার কাছে তিতাস নদীর এক অগভীর হৃদে বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করে। এই যুদ্ধে ৬ জন পাকিস্তানী আর্মি অফিসার নিহত হয়েছেন। ঐ গােলা বারুদের ভাণ্ডারের কাছে এখন যুদ্ধ চলেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণের ধার কমছে
সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত সংবাদ উদ্ধৃত করে ইউএনআই জানাচ্ছে কোন অজ্ঞাত কারণে পাঞ্জাবী এবং বালুচী সৈন্যদের বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থান পরিবর্তন করানাে হচ্ছে।
পূর্ববর্তী এক সংবাদে বলা হয়েছিল পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্যদলের আক্রমণের তীব্রতা লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে পশ্চিম-পাকিস্তানে। বালুচি এবং পাঞ্জাবীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে একথা শােনার পর এই ঘটনা ঘটেছে।
স্বাধীন বাঙলার বেতারের জনৈক সংবাদদাতার মতে নিরস্ত্র জনতার উপর এবং মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আক্রমণে বালুচি সৈন্যরা পাঞ্জাবী সৈন্যদের সঙ্গে সহযােগিতা করছে না।
পাঞ্জাবী সৈন্যরা খাদ্য, পানীয় জল, বিদ্যুৎ পেট্রল এবং অন্যান্য নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের তীব্র অভাব অনুভব করছে।
কৃষ্ণনগরে পাওয়া এক সংবাদে জানা যায়, মুক্তিযােদ্ধারা প্রায় ৬০ জন ছাত্রী সৈন্যকে হত্যা করেছে এবং ১২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কুষ্টিয়া জেলার আমজুপি বিমান কেন্দ্রটি মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে।
হাটে হাড়ি ভেঙেছে !
পাকিস্তান রেডিও একদিকে বাঙলাদেশের অবস্থা শান্ত বলে প্রচার করছে, অপরদিকে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলাে পুনরায় খােলা হচ্ছে বলে প্রচার করেও আজ আবার তিনদিন বন্ধ থাকবে বলে ঘােষণা করেছে।
গত শনিবার বিমান কর্মীরা পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ মানতে যে রাজী হয় নি আজ সামরি তা স্বীকার করেছেন বলে দিল্লী থেকে ইউএনআই সূত্রে জানা গেছে।
কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের করুণ আর্তি
শিলং থেকে ইউ,এন,আই জানাচ্ছে : কুমিল্লাস্থ পাকিস্তানী সৈন্যরা আরাে সৈন্য ও ঔষধ পাঠানাের জন্য ঢাকার হেড কোয়ার্টার এস-ও এস পাঠিয়েছে।
পাকিস্তানী সৈন্যরা লুঠতরাজ শুরু করেছে
আগরতলা ইউএনআই জানচ্ছে : সীমান্তের ওপার থেকে আগত বাঙলাবাসীদের কাছ থেকে জানা গেছে যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকা ও কুমিল্লা ব্যাংক ও বাঙালীদের দোকানসমূহ লুঠ করা শুরু করেছে। কিছু জুয়েলারী দোকান ইতিমধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা লুঠ করেছে।

সূত্র: কালান্তর, ৩১.৩.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!