You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্ত দিনাজপুরে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে
(স্টাফ রিপাের্টার)

গঙ্গারামপুর দিনাজপুর শহরের ভেতর ঘুরে দেখছি। দিনাজপুরে বােমাবর্ষণ হয়েছে বলে যে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে তা ঠিক নয়। শহরের সব দোকানপাট এখনও খােলে নি। ন্যাপ-এর উভয় অংশের কর্মীরা, মুক্তিফৌজ শত্রুদের প্রতি সদস্য সর্তক দৃষ্টি রাখছে। দিনাজপুর স্টেশনে দেখি ট্রেন লাইন বন্ধ, প্লাটফর্মে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য পাহারা দিচ্ছেন।
ঐতিহাসিক রণাঙ্গন সার্কিট হাউসের বিপরীত বড় মাঠ, কুঠিবাড়ি, পুলিস লাইন সব ঘুরে দেখলাম। শেল আর মর্টারের চিহ্ন, দেওয়ালে বিরাট ভাঙন, মেঝেতে শহীদের রক্ত। স্বাধীন বাঙলার পতাকা উড়ছে সব স্থানে। স্বাধীন বাঙলা আঞ্চলিক পরিষদের কনট্রোল রুমে বসে কথা হচ্ছিল মুক্তিফৌজের একজন নেতার সঙ্গে। তিনি বললেন, আমাদের সামনে এখন পাহারা নেই। সীমান্তের অপর পারের বন্ধুরা কোন আক্রমণ করবে না এ বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। বললাম… সাহায্য তিনি বললেন নিশ্চিত।
জয় সম্পর্কে ওদের এত নিশ্চয়তার কারণ বুঝলাম সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচারিত এক নং নির্দেশাবলীর বিবরণবলী দেখে ঐ নির্দেশনামায় অন্যত্র মুদ্রিত স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগ ন্যাপ (ওয়ালী খান) ন্যাপ (ভাসানী) ও অন্যান্যরা।
দুই বাঙলার দ্বার গেছে খুলে। বালুরঘাটে, গঙ্গারামপুরে, মালদায় যেমন স্বাধীন বাঙলার মানুষ এখন অহরহ যাচ্ছেন, ওপার বাঙলার মানুষজনও দীর্ঘ কুড়ি-বাইশ বছর বাদে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের দেখার জন্য এ বাঙলার আসছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর শহরটি মুক্ত করার জন্য এপিআরে উচ্চপদস্থ জনৈক অফিসার মুক্তিফৌজকে পুনসংগঠিত করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং মৌলভিবাজারের কাছে পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্ট নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছেন এবং একটি কম্যাণ্ডের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন।
পাক সৈন্যদের রসদ ফুরিয়ে আসছে। ফলে তাদের মনােবল কমছে দিনের পর দিন। বিশেষ করে রংপুরে এমন কি ঢাকার সৈন্যদেরও সরবরাহ পেতে খুবই অসুবিধেয় পড়তে হচ্ছে।
ঢাকা থেকে কুমিল্লা এবং ঢাকা থেকে সিলেটের মধ্যে সৈন্য চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ বারবার রেলপথ চালু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সৈন্যরা যে মুহূর্তে রেলপথ ঠিক করছে সঙ্গে অন্য আর এক জায়গায় মুক্তিফৌজ রেলপথ তুলে ফেলছে।
সামসের নগরের চাতলপুর অঞ্চলের মুক্তিফৌজের হাতে অস্ত্রশস্ত্র বােঝাই কয়েকটি সাময়িক গাড়ী ধরা পড়ে।
যশােহের লড়াই
নবায়নের সংবাদে জানা গেছে সােমবার রাতে যশাের দখলের জন্য তীব্র লড়াই শুরু হয়েছে।
পাকসৈন্যর যশােহর-ঢাকা এবং যশাের বেনাপোেল রাস্তার ওপর দুটি তিন তলার বাড়ি দখল করে। বেপরােয়া ভাবে ওখান থেকে মেশিনগান এবং মর্টার ছুঁড়তে শুরু করে।
জানা গেছে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্টের চারদিকে প্রায় ৩ কিলােমিটার অঞ্চল ব্যাপি রণাঙ্গন বিস্তৃত করেছে। তাদের এই কৌশল দেখে অনুমান করা হচ্ছে যে তারা চৌরাস্তা মােড় থেকে মুক্তি ফৌজকে হটিয়ে দিতে চায় এবং এইভাবে ঢাকা ও খুলনা যাওয়ার রাস্তাটা উন্মুক্ত করতে চায়। এর ফলে চালনা যাওয়ার পথটাও তাদের কাছে খুলে যাবে। এর উদ্দেশ্য হলাে রবিবার চালনা বন্দরে খাদ্য বােঝাই যে জাহাজটি এসেছে তার খাদ্য রসদ সংগ্রহ করা।
জানা গেছে যশাের খুলনা সড়কে যে অঞ্চল ধরে সৈন্যরা অগ্রসর হচ্ছে সেখানে হাতাহাতি লড়াই হচ্ছে।
মুক্তিফৌজকে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
জনৈক আওয়ামী লীগ নেতা ইউ,এন,আই সংবাদদাতাকে জানালেন দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে মুক্তি ফৌজকে গেরিলা কৌশলের ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে।
কারণ, তিনি বলেন পাক সৈন্যরা কেবল মুক্তি ফৌজকে আক্রমণ করছে। তার নিরস্ত্র জনতার ওপর হামলা করে প্রচুর নিহত করছে।
তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে বেচপাড় গ্রামটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে।
নরসিংদীতে বােমা বর্ষণ
সােমবার পাক বিমান বাহিনী… ওপর বােমাবর্ষণ করে। এই অঞ্চল থেকে মুক্তিফৌজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। এদের এই অভিযান স্তব্ধ করার জন্যই ঐ হামলা করা হয়। নরসিংদী বাজার এলাকায় ৪টি বােমা ফেলা হয়। বাজারের প্রধান বিল্ডিংটির একাংশে ধুলিসাৎ হয়ে গেছে।
এখান থেকে মুক্তিফৌজ বাজেয়াপ্ত করা সাজোয়া গাড়িতে চেপে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। এখন থেকে ঢাকা ১৮ কিলােমিটার দূরে।
শালুডিকার বিমান বন্দর দখল
সিলেটের শালুডিকার বিমান বন্দরটি সােমবার মুক্তিফৌজ দখল করে। এই অভিযানে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৫০ থেকে ৬০ জন সৈন্য নিহত হয়। কয়েকদিন আগে থেকেই মুক্তিফৌজ এই বিমানবন্দরটি অবরােধ করেছিল।
মুক্তিফৌজ সােমবার ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী একটি হেলিকপ্টারকে গুলি করে ভূপাতিত করে।
লালমনিরহাট বিমান বন্দরটি রবিবার পাকসেনাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। আজ রাঙ্গাই এবং ময়মনসিংহ থেকে মুক্তিযােদ্ধরা পাকসৈন্যদের বিতারিত করে।
শনিবার এবং রবিবার বিমান হামলার পর প্রায় ২০ হাজার লােক গৃহহারা হয়েছেন বলে শিলিগুড়ির সংবাদদাতা জানাচ্ছেন। কোচবিহার জেলার দিলহাটা অঞ্চলে যেসব উদ্বাস্তু আসছেন তারা জানিয়েছেন, লালমনিরহাট অঞ্চলে পাকসৈন্যরা নাপাম বােমা বর্ষণ করেছে। এরা বলেছেন এর ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দগ্ধ হয়ে গেছে।

সূত্র: কালান্তর, ৬.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!