মুক্তি বাহিনীর দখলে দিনাজপুর। আট দিনের যুদ্ধে ৩৭০০ পাক সৈন্য নিহত : ৫৬০০ জন আহত
পাকিস্তানী সৈন্যরা শনিবার সন্ধ্যা থেকে যশােরের কাছে চাচড়ার ওপর রকেট এবং ২৬ পাউণ্ডের কামানের গােলা দাগছে। হরিদাসপুর সীমান্ত থেকে ইউএন আই সংবাদদাতা জানাচ্ছেন তীব্র সংগ্রামের পর শনিবার রাতে পাক সৈন্যরা চাচড়ার গুরুত্বপূর্ণ ত্রিমুখী সড়কটি জবর দখল করেছে।
মুক্তিফৌজ কেবল পাকসৈন্যদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আটকে রেকেছে তাই নয় এক গুরুতর সংঘর্ষের পর দিনাজপুর শহরটি মুক্ত করে নিয়েছে। এই সংঘর্ষে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে বলে জানা গেছে। দিনাজপুর মুক্ত হওয়ার ফলে বাঙলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সব বড় বড় শহরগুলি মুক্তি যােদ্ধাদের দখলে গেল।
পাকসৈন্যরা রবিবার বিভিন্ন শহরের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে যায়।
রংপুরে এখনও তীব্র লড়াই চলছে। জনতার প্রতিরােধ ভেঙ্গে ফেলার জন্য পাকসৈন্যরা ক্রমাগত কামান দেগে চলেছে। ইপিআর-এর একটি বড় দল মুক্তাঞ্চল থেকে রংপুরের দিকে ছুটে চলেছেন বলে জানা গেছে।
সিলেটের বিমানবন্দর এবং ঢাকা সিলেট রােডের সংযােগকারী মেঘনা নদের ওপর ভৈরব সেতুটি মুক্তিযােদ্ধারা ধ্বংস করে দিয়েছে। জানা গেছে জাকিগাঁও সিলেটের চরখাই সেতুটিও ধবংস হয়ে গেছে । ঐ অঞ্চলের সংবাদ হলাে সিলেটের সংলগ্ন মুক্তিবাহিনীর ওপর পাকসৈন্যরা যে কোন সময়ে আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছে।
বাঙলাদেশের পূর্বাঞ্চল বানুগাছি অঞ্চলে রবিবার ছত্রী সৈন্য নামানাে হয়েছে। সামনের নগরের রেল স্টেশনটি এবং পেট্রল স্টেশনগুলি অবিরাম বােমা বর্ষণের ফলে ধ্বংস হয়েছে।
যশােরে যে পাকিস্তানী সৈন্যরা অবরুদ্ধ হয়ে আছে তাদের একটা অংশ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তি যােদ্ধারা সেই প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দেন।
কুমিল্লা বিমান বন্দরের পাঁচ কিলােমিটার সংলগ্ন অঞ্চল থেকে জনগণকে সরে যাওয়ার জন্য সৈন্যরা নির্দেশ দিয়েছে। কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মধ্যে যােগাযােগ নষ্ট করার জন্য মুক্তিফৌজ সুভপুর সেতুটি ধ্বংস করে দিয়েছে।
বাঙলাদেশের উত্তরাংশে ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তার মধ্যবর্তী সমস্ত অঞ্চল মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে। পাট গ্রাম এবং লালমনিরহাট-এর মধ্যে রেলপথটি আবার মেরামত করা হয়েছে। পাকসৈন্যরা এই রেলপথটি ধবংস করেছিল।
রংপুর থেকে দিনাজপুরগামী ৪টি ট্রাকের একটি কনভয়কে মুক্তিফৌজরা মাঝপথে থামায় এবং অস্ত্রশস্ত্র দখল করে।
কুষ্টিয়া এবং রাজশাহী থেকে আরও উদ্বাস্তু রবিবার ভারতে এসেছে। উদ্বাস্তুদের মধ্যে ই,পি, আরের ২ জন পাঠান এবং বুড়িমারার ২ জন অবাঙালী রেল কর্মচারী আছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা জনসাধারণের সাহায্য লাভে বঞ্চিত হয়ে নিরস্ত্র জনতার ওপর নির্বিচারে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। জনসাধারণও সুযােগ বুঝে এর প্রতিশােধ নিচ্ছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে শ্রমিকদের দিয়ে মাল খালাস করার চেষ্টা বারে বারে ব্যর্থ হয়েছে। জাহাজ গুলিতে কোন সমরম্ভার নেই এই প্রতিশ্রুতি নিয়েও কাজ করানাে সম্ভব হচ্ছে না।
যশােরের কাছে যে ত্রিমুখী সড়কটি পাক সৈন্যরা দখল করেছে সেই পথটি যশাের এবং ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে সংযােগকারী সড়ক। চারদিন আগে মুক্তিফৌজ এর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, ফলে সৈন্যদের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর দরুণ সৈন্যদের শহর থেকে কান্টনমেন্টে পিছিয়ে যেতে হয়েছিল । পাক-সৈন্যরা এটি দখলের পর খুলনার দিকে আরও ৮ কিলােমিটার এগিয়ে গেছে।
যশাের শহরের ওপর শনিবার দুপুর আড়াইটা থেকে পাকসৈন্যরা আবার তীব্র আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের পূর্বে সৈন্যদের কাছে বিমানে করে নতুন রসদ আসে।
সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্টের উত্তরপশ্চিম দিকের গ্রামগুলির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ৭টি গ্রাম সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে এবং হাজার কয়েক লােক নিহত হয়েছে।
এই পরাজয়ের কারণ বর্ণনা করে ১ জন ই-পি-আর সদস্য সংবাদদাতাকে বলেন পাক সৈন্যরা যখন ২৬ পাউণ্ডের গােলা ব্যবহার করছে তখন মুক্তি ফৌজের হাতে মাত্র ৬ পাউণ্ডের গােলা ব্যবহার করার কামান আছে। আর একজন সদস্য বলেন শনিবার যে বিমান গুলি রসদ আনছিল মুক্তিফৌজ সেগুলির ওপর ব্যর্থ আক্রমণ করে। তিনি বলেন আমাদের কাছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থাকলে ত্রিমুখী সড়কের কাছের বাঙ্কারগুলি রক্ষা করা সম্ভব হতাে।
তিনি বলেন, যে গ্রাম গুলির ওপর কামান ছোঁড়া হয়েছে তার জনসংখ্যা ৫ হাজার এর অর্ধেক জনসংখ্যা গ্রাম ত্যাগে সক্ষম হয়েছে।
৩৭০০ পাক সৈন্য নিহত
আওয়ামী লীগ নেতা মহম্মদ ইদরিস ইউ,এন,আই, এর সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন যুদ্ধের প্রথস ৮ দিনে মুক্তি ফৌজের হাতে ৩৭০০ পাক সৈন্য নিহত হয়েছে এবং ৫৬০০ জন বন্দী হয়েছে।
সূত্র: কালান্তর, ৫.৪.১৯৭১