আড়াই কোটি মানুষ আজ স্বাধীন বাঙলার অধিবাসী
দেশপ্রেম আর অদম্য উৎসাহই বাঙলাদেশের প্রধান অস্ত্র
কুষ্টিয়া, ৯ এপ্রিল সারা বাঙলাদেশের এক তৃতীয়াংশ নাগরিক আজ স্বাধীন বাঙলায় বাস করছেন। সমগ্র প্রদেশের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল বাঙলাদেশের মানুষের নিরস্ত্রণাধীন বলে জানাচ্ছেন এপি’র সংবাদদাতা। সারাদেশের মানুষের কাছে আজ প্রধান হাতিয়ার হল অসীম দেশপ্রেম আর অপার উৎসাহ। আড়াই কোটি মানুষের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব ঘটনা।
গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা নদী বরাবর সমগ্র দেশ মাঝামাঝিভাবে বিভক্ত। এই নদী সামগ্রীর পশ্চিমাঞ্চলের বহু শহর, গ্রাম ও গঞ্জ এখন বাঙলাদেশের স্বাধীন মানুষের শাসনাধীন।
এই সাম্রাজ্যে প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায় কুষ্টিয়া শহরে। ভারতের সীমানা থেকে ৪৮ কিলােমিটার পূর্বে এবং কলকাতা থেকে ১৬৮ কিলােমিটার উত্তর পূর্বে এই শহরটি অবস্থিত।
এখানে বাঙলাদেশের শাসকমন্ডলী স্থানীয়ভাবে রেল চালাচ্ছে। পুলিশ ও পােস্ট অফিসের কাজও সরকার চালাচ্ছে।
এখানে কর আদায় করা হচ্ছে, তা স্থানীয় ব্যাংকে জমা পড়ছে। পরে সময় হলে তা বাঙলাদেশের কেন্দ্রীয় খাজনাখানায় জমা পড়বে।
এখন কুষ্টিয়া শহরের জনসংখ্যা হল ৩০ হাজার এবং ১৫ জন সদস্যের এক জেলা সগ্রাম কমিটির দ্বারা তা পরিচালিত।
কুষ্টিয়ার ডেপুটি কমিশনার মুহম্মদ সামসুল হক বলেন যে অন্যান্য মুক্ত অঞ্চলের শহর ও গঞ্জগুলিতে অনুরূপ কমিটি গঠন হয়েছে।
উক্ত ডেপুটি কমিশনারই জানিয়েছেন যে, নদী সীমার পশ্চিমাঞ্চলে কয়েকটি সৈন্য ছাউনি ও দূর্গ ছাড়া সমস্ত অঞ্চলই বাঙলাদেশের হাতে। তবে উভয় পক্ষকেই অনেক বেশী মূল্য দিতে হয়েছে।
গত ২৫ ও ২৬ রাত্রে পাকিস্তান বাহিনী পূর্ববঙ্গের সমস্ত প্রধান প্রধান শহরগুলি দখল করার চেষ্টা করেছিল। আর তখনই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেন। এখানে, এই কুষ্টিয়া শহরে, সৈন্যবাহিনী তার কর্তব্য সাধনে ব্যর্থ হয় এবং এখানকার বালুচ বাহিনীর ২৪৭ জন সৈন্যই এখানে খতম হয়েছে।
কুষ্টিয়া মুক্ত করার লড়াই
সামসুল হক এই শহর মুক্ত করার যুদ্ধের বর্ণনা দেন :
২৫ মার্চ মধ্যরাত্রে সৈন্যবাহিনী পুলিশ লাইন, থানা, টেলিফোন এক্সেচেঞ্চ, রেডিও যােগাযােগ কেন্দ্র ও শহরের সর্ববৃহৎ বিদ্যালয় জেলা স্কুলটি দখল করতে যায়। পরদিন শহরে কারফিউ জারি করা হয় এবং তা অমান্য করার জন্য ৪ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
শহরটি ৩০ মার্চ পর্যন্ত সৈন্যবাহিনীর হাতে ছিল। সেই রাত্রিতেই পুলিশ পূর্ব-পাকিস্তান বাহিনী, আনসারও মুজাহিদ বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। শহরের রাস্তায় বাঙলাদেশ ধ্বনি দেন। ভাের হবার আগেই বাঙলাদেশ বাহিনী আক্রমণ শুরু করে।
সকাল ৮ টায় স্থানীয় পুলিশ লাইনের পতন ঘটে। সেখানকার তিনতলা বাড়িটিতে এখনাে বহুগুলির চিহ্ন রয়েছে, তাতে কি প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে বােঝা যায়। দু’ঘণ্টা পরে থানা ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করা হয়।
সৈন্যদল তখন জেলা স্কুলে ঘাটি করে থাকে। রাত্রির অন্ধকারে বাকী সৈন্যরা সেই ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে যশাের ফিরে যাবার চেষ্টা করে। যশাের ছাউনি এখান থেকে ৮৮ কিলােমিটার দূরে।
সৈন্যরা কয়েকটি গাড়িতে যাত্রা করে। অন্ধকারের মধ্যে তীব্র আলাে জ্বেলে তারা সরে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙলাদেশের মুক্তিফৌজ ইতিমধ্যেই রাস্তাঘাট কেটে ও বাধা সৃষ্টি করে রেখেছিল।
সৈন্যবাহিনী গাড়িগুলি পথে আটকে পড়ে গ্রামের দিকে সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামবাসীদের হাতে কেহই প্রায় নিস্তার পায়নি। খুব সামান্য লােকই পালাতে সক্ষম হয়েছে। ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে । বাঙলাদেশ বাহিনীর ৪ জন নিহত ও একজন আহত হয়েছে। দিনের বেলায় গুলি বিনিময়ের সময় ২ জন বে-সামরিক লােক নিহত হয়েছে।
এর প্রতিশােধ নেবার জন্য পাকিস্তান বিমানবাহিনী ৩১ মার্চ শহরের উপর বিমান আক্রমণ শুরু করে। তবে কোন হতাহত হয় নি।
তারপর থেকে কুষ্টিয়ার অবস্থা শান্ত।
সামসুল হক বলেন যে, বেশ কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী বেসামরিক লােকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাউকেই অনেকেই কুষ্টিয়ায় নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন।
কুষ্টিয়া থেকে ১৩ কিলােমিটার দূরবর্তী চুয়াডাঙ্গায় বাঙলাদেশের মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণ-পূর্ব কমান্ডের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়েছে।
আঞ্চলিক কমান্ডার মেজর ওসমান চৌধুরী বলেন যে, পাকিস্তান বাহিনী পদ্মা নদীর পূর্ব তীরে সমবেত হচ্ছে। সম্ভবত নদী পার হয়ে আক্রমণ চালাবার জন্য তারা প্রস্তুত হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গায় শােনা খবরে জানা গেছে যে, রাজশাহী ছাউনি অঞ্চল মুক্ত হয়েছে। সেখানে ১৯ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও ২০০ জন বন্দী হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গায় প্রাপ্ত আরও খবরে জানা গেল যে, রাজশাহীতে সাদা নিশানে ধোকা দিয়ে পাকসৈন্যরা প্রায় ৭০০ মুক্তিসেনাকে হতাহত করেছে। বাঙলাদেশের মানুষ মনে করছে যে, যদি বর্ষা পর্যন্ত এই প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়া যায় তবে জয় সুনিশ্চিত।
কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার মধ্যবর্তী পুলগুলি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই দুই শহরের মধ্যবর্তী ৮ কিলােমিটারের দূরত্ব অতিক্রম করতে একটি জিপের ৫ ঘণ্টা । খামারের উপর দিয়ে কোন রকমে পথ চলা যায়। ভারী সৈন্যবাহী ট্রাকের পক্ষে তা সম্ভব নয়।
স্থানীয় সরকারী দপ্তর, পুলিশ ও মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিংগুলির সর্বত্র বাঙলাদেশের পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। গ্রামবাসীরা পরস্পরকে “জয় বাঙলা” বলে সম্বােধন করছে।
এপি’র সংবাদদাতা বলেন যে, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার নাগরিকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর অসন্তুষ্ট কারণ পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর হিংসাত্মক কাজের নিন্দা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
সূত্র: কালান্তর, ১০.৪.১৯৭১