You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৫ই মে, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতার শত্রুদের নির্মূল করতে হবে

পোস্তগোলার জনসভায় গত পরশুদিন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভাষণ দিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মালেক উকিল উক্ত জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রবিরোধী কোন কাজ ও কথা সরকার বরদাশত করতে রাজী নয়। যারা এধরনের রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয় এমন কোন কথা ও কাজ সরকার কঠোর হস্তে দমন করতে বদ্ধপরিকর। বক্তৃতার অন্য এক অংশ বলেন, একশ্রেণীর লোক গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে। যারা এধরনের কাজে লিপ্ত তারা শুধু সরকারের নয় গোটা জাতির শত্রু। তিনি জনগণকে এ ধরনের মানুষকে চিনে রাখার আহ্বান জানিয়ে সতর্ক থাকতে বলেন। দেশে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্যেই সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ রাখা হয়। আমাদের সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে জনাব আবদুল মালেক উকিলের উপর। জনাব মালেক দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন তা যেমন অর্থবহ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে বিভিন্ন উপায়ে দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে একশ্রেণীর লোক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশী বিদেশী আঁতাতের মাধ্যমে স্বাধীনতার শত্রুরা তাদের কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছে। একথা আজ আর অস্বীকার করে লাভ নেই যে, বাংলাদেশের বাস্তবতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল তৎপর। আজো এদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে পারেনি বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশ। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে নতুন ষড়যন্ত্রের পাঁয়তারা শুরু করেছে। উপমহাদেশীয় শান্তি তথা বিশ্বশান্তি ব্যাহত করছে। পাকিস্তানের শাসকবৃন্দ আজো চীনা নেতৃবৃন্দের আঁতাত করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশের ভিতরের কিছু সংখ্যক রাজনীতিক এবং তাদের সহযোগীরাও মিলিতভাবে সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছে সন্তর্পণে। আমাদের সরকারকে এ সকল মহলের গতিবিধি খুঁজে বের করতে হবে এবং স্বাধীনতার শত্রুদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন যারা দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সর্বাত্মক যোগসাজশ করে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছিলো তারা এখনও সমাজ দেহ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। যে সকল আমলা বা বড় বড় পুঁজিপতি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের বুদ্ধি দিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলো তাদের অনেকেই এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে এমন অনেক কাজই এরা অত্যন্ত সন্তর্পণে করে চলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্যই পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন আমলাদের ও কর্মচারীদের লক্ষ্য করে থাকবেন স্বাধীনতার যারা শত্রু তাদের কথা ও কাজের বিরুদ্ধে যদি সত্যই কিছু করণীয় থাকে তাহলে অফিস আদালতের কর্মচারীদের তৎপরতাও অবশ্যই লক্ষণীয়। আমরাও সর্বান্তকরণে চাই দেশের শত্রু যারা তাদেরকে সমাজ দেহ থেকে নির্মূল করে একটি আদর্শভিত্তিক দেশ গড়ে তোলার জন্যে সকল আবশ্যকীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

রফতানীযোগ্য পণ্যের উৎপাদন

বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তবুও রফতানী ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। হিসেব নিয়ে দেখা গেছে, চলতি রফতানী মওসুমে বাংলাদেশে গত মার্চ পর্যন্ত প্রায় দু’শ’ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য রফতানী করতে সক্ষম হয়েছে। চলতি রফতানী মওসুমে সর্বমোট তিনশ’ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত করা হয়েছিলো। বাকী তিন মাসে বাংলাদেশ রফতানীর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে অসমর্থ হবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। রফতানী ব্যবসায় বাংলাদেশের এই ব্যর্থতার পেছনে অবশ্য নানা কারণ বিদ্যমান। গত এপ্রিলে ডিজেল, পেট্রোল, ন্যাপথা তথা জ্বালানী সংকটের জন্য রফতানী ব্যাহত হয়েছে, একথা আমরা সবাই অবগত আছি। বাংলাদেশ বিদেশে যে সব পণ্য রফতানী করে থাকে সেগুলোর মধ্যে কাঁচা পাট, মেশতা পাট, শিমূল তুলো, মাছ, চামড়া, মশলা, চা, অশোধিত সার, নিউজপ্রিন্ট, হার্ড বোর্ড, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য, ওষুধপত্র, বই ইত্যাদি। পাট, পাটজাত দ্রব্য এবং চামড়া এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের ট্রাডিশনাল রফতানী পণ্য। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, শুধুমাত্র ট্রাডিশনাল পণ্য নয়—নন ট্রাডিশনাল পণ্য রফতানীরও ব্যবস্থা করলে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে নিশ্চিত লাভবান হবে। বিদেশের চাহিদা মাফিক বাংলাদেশ রফতানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সময়মতো পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করতে পারছে না। রফতানীযোগ্য পণ্যের জন্য কর্তৃপক্ষকে উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর দিকে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হচ্ছে। কাজেই বিদেশে রফতানীযোগ্য পণ্যের উৎপাদন ও উন্নয়ন সাধন করা একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। নইলে রফতানী বাণিজ্যিক চাঙ্গা করে তোলা সম্ভব হবে না।
রফতানী পণ্য যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি অন্যতম প্রধান মাধ্যম সেইহেতু আমরা রফতানীযোগ্য পণ্যের প্রতি মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা দরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত মিল কারখানাগুলো এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি বড়ো ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা জানি, বিভিন্ন কল-কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, বিদ্যুত বিভ্রাট, খুচরা যন্ত্রাংশের অপ্রতুলতা ইত্যাদি রয়েছে। ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে অচলায়তন দেখা দিয়েছে। কল-কারখানার অঙ্গন থেকে এই অচলায়তনের পাহাড় সর্বাগ্রে অপসারণ করতে হবে। নইলে উৎপাদন হবে না আমরা বিদেশে বাংলাদেশের পণ্য রফতানী করতে দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হবো। বাংলাদেশের রফতানী ব্যবসার যে উজ্জল ভবিষ্যত রয়েছে তাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। রফতানী বাণিজ্য সম্পর্কে আমরা যতো বড়ো বড়ো বুলিই কপচাইনা কেন, কলে-কারখানায় উৎপাদন না বাড়ালে, সেই সব বুলি নিতান্ত বায়বীয় পদার্থেই পরিণত হতে বাধ্য।

চটকল ধ্বংসের ষড়যন্ত্র

স্বাধীনতার পর থেকেই সর্বাত্মক চেষ্টায় চটকলসহ সবরকম কল-কারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর জন্যে শিল্প কারখানাগুলোকে সরকার জাতীয়করণও করেছেন। কিন্তু নানান ভুল-ভ্রান্তি, লকআউট ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য সরকারকে বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। যার ফলে একমাত্র মার্চ মাসেই চটকলগুলো তিন কোটি উনষাট লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা হারিয়েছে, দশ হাজার টন উৎপাদন কম হয়েছে এবং উৎপাদন দক্ষতা কমে শতকরা তেতাল্লিশ ভাগে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন হ্রাসের ফলে চটকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রতিমাসে এক কোটি টাকা। বৈদ্যুতিক গোলযোগের ফলে চটকলগুলো লোকসান দিচ্ছে দু’কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতির তালিকার পরও সমস্যা আছে। অনেক চটকল পাট কেনা বন্ধ রাখায় কৃষকগণ সমস্যায় পড়েছে ও পাটচাষ কম করছে এবং কতিপয় কুচক্রীদের কারসাজিতে কোটি টাকার পাটজাতদ্রব্যও আটকে পড়ে থেকে লক আউটের সম্ভাবনাকে ডেকে আনতে। নরসিংদী এবং ঘোড়াশাল এলাকার চটকলগুলো অচিরেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। চটকল বন্ধ হয়ে যাবার গুজব শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে।
খবরে আরও প্রকাশ যে, একশ্রেণীর ঊর্ধ্বতন কর্মচারীবৃন্দই ‘চটকলগুলো বন্ধ অচিরেই হয়ে যাবে’-এই অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে এবং এতে কিছু সংখ্যক বহিরাগতও জড়িত থেকে উস্কানি যোগাচ্ছে।
শুধু ষড়যন্ত্রই নয়, শ্রমিক এবং কর্মকর্তা ‍উভয় পক্ষ থেকেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, রাতের অন্ধকারে ও দিনের বেলায়ও লক্ষ লক্ষ টাকার যন্ত্রপাতি মিল থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে চটকলগুলোকে যন্ত্রপাতি চুরির লোকসান দিতে হচ্ছে প্রতি মাসে তিন লক্ষ টাকা।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে প্রকৃতই যে বাংলাদেশের পাটশিল্প একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হবে। এমতাবস্থায় আর কালবিলম্ব না করে জরুরী ভিত্তিতে যুগবৎ চটকলগুলো বাস্তব সমস্যা দূরীকরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া এবং দেশীয় স্বার্থবিরোধী এই সকল কতিপয় কুচক্রীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!