যশাের জেলায় চৌগাছা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে ইয়াহিয়া বাহিনীর উন্মত্ত তাণ্ডব
মুক্তিফৌজের পাল্টা আক্রমণে কোণঠাসা হানাদারদের পােড়ামাটি নীতি
(সীমান্ত সফররত স্টাফ রিপাের্টার)
বয়গাগ্রাম (বনগাঁ-যশাের সীমান্ত), ২৪ এপ্রিল— যশাের রণাঙ্গনে ইয়াহিয়া বাহিনীর প্রবল আক্রমণ প্রতিহত করে মুক্তিফৌজ পাল্টা আক্রমণ হানবার জন্য যখন উদ্যত, সে সময় পাক হানাদারেরা তাদের পােড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে ব্যাপক লুঠতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলায় নতুনভাবে মেতে উঠেছে।
তারই নির্দশন পেলাম এখন থেকে মাইল পাচেক দূরের চৌগাছ বাজারে। যশাের শহর থেকে চৌগাছা ১৫ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। গত মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল ইয়াহিয়ার প্রায় ৩০০জন সৈন্য সকাল ১১টা নাগাদ অতর্কিতে চৌগাছায় হানা দেয়। এরপরেই বাজার সন্নিকটস্থ বিভিন্ন বাড়ির উপর তিন ইঞ্চি মর্টার, তােপখান (ছােট কামান) ও মলােটভ ককটেল আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। এগুলাে পার্শ্ববর্তী গ্রামেও গিয়ে পড়ে। প্রথমে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দুটো পাটগুদাম ভেঙে ফেলা হয় এবং তারপর গুদামজাত পাটের উপর পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় অধিবাসীদের বিবরণে প্রকাশ, প্রায় সহস্রাধিক মন পাট এভাবে অগ্নিস্যাৎ করা হয়েছিল। এছাড়া মােমিনপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেড এর একটি কাপড়ের দোকান থেকে ইয়াহিয়া বাহিনী তিরিশ সহস্র টাকার কাপড় লুঠ করে নিয়ে যায়। এবং আরাে কয়েকটি বাড়িও ধ্বংস করে দেয়।
পথে পার্শ্বস্থ একটি হােটেলের উপর পেট্রল ছড়িয়ে হােটেলটিকে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে যশাের সৈন্য ছাউনী অভিমুখী সদর রাস্তার উপর অবস্থিত ন্যাশনান্স ব্যাংক অব পাকিস্তানের একটি শাখা থেকেও পাক হানাদারেরা অর্থাদি লুঠ করে। ঐ উন্মত্ত তাণ্ডবলীলা চলাকালে ইয়াহিয়া ফৌজ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে একটি সরকারী দপ্তরেও চৌগাছা সাব রেজিস্ট্রি অফিস আগুন লাগিয়ে যায়। এই তাণ্ডবে নিহতের সংখ্যা দুই হলেও অনেকেই আহত হয়েছেন। বেলা আড়াইটে পর্যন্ত এই তাণ্ডবলীলা চলে। তারপর লুঠেরারা ফিরে যায়। ঐ সময় জ্বালিয়ে দিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহ— বিশেষতঃ সিংহঝুলি ও স্বরূপদাহ। সিংহঝুলি থেকে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য মুশিয়র রহমানকে গ্রেপ্তার করে ইয়াহিয়া বাহিনী তার বাড়িটিকে ভেঙে ফেলে।
চৌগাছা বাজারে বসে কথা হচ্ছিল স্থানীয় বৃদ্ধ হাজী রিয়াজুদ্দীনের সঙ্গে। যশাের শহর ও চৌগাছায় তাঁর বেকারীর ব্যবসা আছে। ইয়াহিয়া বাহিনী সম্পর্কে জানালেন, তারা ঢুকে প্রথমেই ইপিআর, মােজাহিদ ও হিন্দুদের খোজ করেছে। হাজী সাহেবের এক কন্যাকে ওরা জবরদস্তী করে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। উনি প্রচুর অর্থ ও একটি মােটর সাইকেলের বিনিময়ে কোনক্রমে নিজের কন্যার সম্মানরক্ষা করতে পারলেন।
যে দুটো পাট গুদাম হানাদাররা ভেঙে ফেলেছে সেগুলির সামনে পুরােদস্তর ধ্বংসস্থূপ। সেই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে এখনও কালাে ধোঁয়া উঠছে। অর্থাৎ পাট এখনও জ্বলছে। এই দুটি পাট গুদামের মালিক আবদুল কাদের মিরধা ও এনামুল হক। হক সাহেব জানলেন কি প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে গেল তার। “আমাদের ওরা ভিখিরী বানাতে চায় তাদের এই তাণ্ডব।” এইভাবে তাণ্ডব করে চলে যাওয়ার একটাই কারণ— জনগণের মনে সন্ত্রাস কায়েম করা। পথে আসতে আসতে কথা হচ্ছিল জনৈক মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে। উনি এবং ওর সঙ্গী আমাদের পথ প্রদর্শক।
১৯৬৩ সাল থেকে মুজাহিদ বাহিনীতে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় বনগা যশাের সীমান্ত সংঘর্ষজনিত লড়াইয়ে যােগ দিয়েছিলেন। বললেন, “ইয়াহিয়া খাঁ কইছে, ‘হমে বঙাল কী জানতা কো নেহী চাহিয়ে, হামে সির বঙালকে জমিন চাহিয়ে। তাই তাে এই যুদ্ধ।” একটু থেমে আবার বললেন, “যুদ্ধে জিততে গেলে চাই বুদ্ধি। সেটা আমাদের আছে। ওদের কিন্তু সেটা নেই। আবার আমাদের নেই ভারী, উন্নত অস্ত্র। ওদের আছে। অন্ত্র মােটামুটি পেলে কম লােক নিয়েও ওদের হারাতে পারি।”
সামনে কপােতাক্ষ নদী। বয়ে চলেছে চৌগাছার পাশ দিয়ে। আবার বষরাকেও বেড় দিয়েছে এই একই কপােতাক্ষ। মাইকেলের জন্মভূমি সাগরদাঁড়ির সঙ্গে যে কপােতাক্ষর নাম বঙ্গ-সাহিত্যে চির-উজ্জ্বল। দিগন্ত বিস্তৃত কচি ধানক্ষেতের উপর জলভার আকাশ। ছবির মত গ্রাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। অথচ খা খা করছে পরিবেশ। শ্মশান ভূমির স্তব্ধতা আলাের হারিকেন লুণ্ঠনের আভাস নেই কোথাও।
এই স্তব্ধতা ভেদ করে সহসা মুক্তিযােদ্ধাটির সঙ্গীসহযােদ্ধা জানালেন, “বুঝলেন, গতরাতে নাভারণ আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ পাক-বাহিনীকে ঝিকরগাছা পর্যন্ত ঠেলে দিছে। এবার আমরা পাল্টা আক্রমণ করছি।” তারপর বললেন, “অনেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গেছেন ঠিকই, কিন্তু নিজের চোখে দেখছি বহু কৃষক নিরাপদ স্থানে মেয়ে-বৌ রেখে সাহস করে আবার গ্রামে ফিরেছেন চাষাবাসের জন্য। এইটা খবর, লিখবেন।”
এবার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। দৃঢ় পায়ে হেঁটে চলেছেন মুক্তিযােদ্ধা বন্ধুটি। হঠাৎ বলে উঠলেন, “মুসলীম লীগ পার্টিটার নেতাদের গুলি করে মারা উচিত। ওদের গায়ে মীর জাফরের রক্ত। ওরা কি বলছে জানেন? বলছে, হিন্দুদের কথা শুনে শেখ সাহেব তাে যুদ্ধ করলেন, ওদিকে হিদুরা পলাইল আর আমাদের প্রাণ যায়। এইভাবে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। তাই ইদানিং হিন্দুদের উপর জুলুম বেশী হচ্ছে। কিন্তু আমার এরা সাধারণ মানুষ একে বরদাস্ত করছি ওঁর কণ্ঠে শুনলাম সংগ্রাম স্পন্দিত প্রগাঢ় ভালবাসার সুর। পথ শেষ হয়ে এল এবার বিদায়ের পালা। ওঁরা না থাকলে যেতে পারতাম না। দেখতে পারতাম না পাক-বীভৎসতার নিদর্শন। কৃতজ্ঞতায় উষ্ণ আন্তরিকতার জড়িয়ে ধরলাম ওদের হাত। তারপর ওরা হাত তুললেন সেলাম আলেকুমের ভঙ্গীমায়। আর আমাদের হাতে লাল সেলাম। ওরা, আমরা একসঙ্গে বলে উঠলাম ‘জয় বাঙলা’—মুক্তি সংগ্রামী বাঙলাদেশের পরিচয় পত্র।
সূত্র: কালান্তর, ২৫.৪.১৯৭১