ভাষা আন্দোলনে সৈয়দপুর
অবাঙালি-অধ্যুষিত শহরে ভাষা আন্দোলন
সাতচল্লিশে (১৯৪৭) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তপাতে বিষাক্ত দেশবিভাগের এক অবাঞ্ছিত ফল বাস্তুত্যাগের ট্রাজেডি। এবং তা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই সত্য। যেমন বাংলায়, তেমনি পাঞ্জাবে। যাওয়া-আসার এই করুণ আলেখ্য সাহিত্যেও স্থান পেয়েছে, সংবাদপত্রে তাে বটেই।
মুসলিম লীগের যুক্তিহীন দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাপক প্রভাবে বাঙালি মুসলমান সাময়িকভাবে ভেসে গিয়েছিল এবং ধর্মীয় ঐক্যকে জাতীয় ঐক্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে এক অবৈজ্ঞানিক বিভ্রান্তিকে সত্য বলে মেনে নেয়। ফলে পূর্ব থেকে পশ্চিমবঙ্গমুখী উদ্বাস্থযাত্রা যথাযথ অভ্যর্থনা ও গ্রহণযােগ্যতা না পেলেও ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন শহরে আসা অবাঙালি উদ্বাস্তুদের (বিহারি নামে পরিচিত) বাঙালি ‘মুসলমান ভাই’ বলে আত্মীয়জ্ঞানে কাছে টেনে নেয়। ধর্মভাই বলে কথা।
প্রান্তিক সীমান্ত শহর যশাের, খুলনা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের একাধিক মহকুমা বা থানা শহরে দাঙ্গাবিধ্বস্ত বিহার অঞ্চল থেকে আসা মুসলমান উদ্বাস্তু (ওদের ভাষায় মােহাজের) পূর্ববঙ্গে তাদের আবাস স্থায়ী করে নেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে মােহাজেরদের পুনর্বাসনে ছিল বিশেষ আয়ােজন, উষ্ণ আন্তরিকতা। রাজধানী ঢাকা শহরসংলগ্ন মােহাম্মদপুর, মিরপুরে বিশাল কলােনি তার প্রমাণ। কিন্তু বিহারি বা উত্তর ভারতীয় মােহাজেররা বাঙালি- আন্তরিকতার প্রতিদান দিতে পারেনি। তারা নিজেদের বাঙালিদের থেকে পৃথক ভেবেছে ভাষা-সংস্কৃতি ও জাতীয়তার বিবেচনায়। এর বিষময় ফল বিদ্বেষ ও রক্তস্রোতে প্রকাশ পেয়েছে।
অবাঙালি-প্রধান আমলাতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ রাজনীতি নীতিগত ও সহমর্মিতার কারণে বিভেদ-বিভাজন স্থায়ী চরিত্র অর্জন করে। প্রশাসনিক সমর্থনপুষ্ট মােহাজেরদের মনে একধরনের উচ্চম্মন্যতা বড় হয়ে ওঠে, তেমনি প্রাধান্য পায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি বিরূপতা। মােহাজেরদের বড়সড় অংশ ছিল শ্রমজীবী ও কারিগর শ্রেণির মানুষ। এ জাতীয় মানসিকতার ব্যতিক্রম আঙুলে গােনা জনাকয় ব্যক্তি। মােহাজেরদের স্বাতন্ত্র্যবাদী মানসিকতার কুপ্রভাব পড়ে রাজনীতিতে, যা প্রকটভাবে প্রকাশ পায় একাত্তরে এবং বিভাগােত্তরকালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।
পূর্ববঙ্গের আমলাতন্ত্রে ছিল অবাঙালিদের প্রাধান্য, তেমনি নিম্নস্তরের পেশায় ও কর্মে মােহাজেরদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। উদাহরণ রেলওয়ে ও কারিগরি পেশা। সৈয়দপুরে অন্যতম প্রধান রেলওয়ে ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং বিশেষ কিছু কারণে ছােট শহর সৈয়দপুরে ছিল মােহাজেরদের প্রাধান্য। যেমন অংশত ঈশ্বরদীতে। আবার সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও তাদের উচ্চম্মন্যতা এবং বাঙালির হীনম্মন্যতার কারণে সমাজে প্রায়ই অবাঙালি প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে। যেমন : যশাের, ঝিনাইদহ, খুলনা, নীলফামারী ইত্যাদি শহর।
রংপুর জেলার অন্তর্গত নীলফামারী মহকুমার একটি থানা শহর সৈয়দপুর। স্বভাবতই সৈয়দপুরে ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন জোরকদমে চলেনি, বলা যায় চলতে পারেনি। এমনকি ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন দেশময় ভাষা আন্দোলনের জোয়ার বয়ে গেছে, তখনাে দুটো কারণে সৈয়দপুর আন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষেত্রে সমান্তরাল মাত্রায় সহযােগী হতে পারেনি।
এ বিষয়ে সৈয়দপুর থেকে সাংবাদিক সাকিব হােসেন বাদল তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, সৈয়দপুরে ভাষা আন্দোলনের প্রধান শত্রু অবাঙালি জনগােষ্ঠী। তাঁর ভাষায়, ‘আটচল্লিশের জিন্নাহর ভাষণের পর থেকে এরা আসল চেহারা দেখাতে শুরু করে। সৈয়দপুরের একমাত্র হাইস্কুলে তারা জোর করে শুরু করায় উর্দু লেখাপড়া। ফলে বাধ্য হয়েই একই স্কুলে চলত দুই শিফট। প্রথম শিফটে লেখাপড়া করত অবাঙালি, দ্বিতীয় শিফটে পড়ত বাঙালি ছাত্ররা। পরে অবাঙালি ছাত্রদের জন্য তৈরি হয় আলাদা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যার নাম হয় “কায়েদে আজম স্কুল”।’
‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’—১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর এমনধারা ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় ‘সৈয়দপুরে প্রথম ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় হাইস্কুলের ঐতিহাসিক কাঠালতলায়। সভা পরিচালনা করেন ছাত্রনেতা মুজিবুর রহমান। সভায় বক্তব্য দেন ছাত্রনেতা মােতালেব, আবদুল বাসেত, মীর সুরত আলী, নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও অন্যরা।’
ছাত্ররা ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হতে থাকেন। তারা আশপাশ এলাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা-বিষয়ক সচেতনতা তৈরির জন্য জনসাধারণের সঙ্গে যােগাযােগ ও বৈঠক শুরু করেন। এ কাজের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি বিশেষ নাম নজরুল ইসলাম চৌধুরী।
তাঁর স্মৃতিচারণায় দেখা যায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের হামলার ঘটনা। সেই সঙ্গে বেশ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার। প্রকৃতপক্ষে আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে করতে না পারার প্রথম কারণ সংঘবদ্ধভাবে বিহারিদের বিরােধিতা, দ্বিতীয় কারণ, জবরদস্ত পুলিশি হামলা। অনেকটা নিজ দেশে পরবাসীর অবস্থা বাঙালিদের। তারপরও আন্দোলনের বিরােধিতায় অবাঙালিদের পুলিশের সঙ্গে সহযােগিতা। এ অবস্থার চরম রূপ দেখে গেছে একাত্তরের ঢাকাসহ গােটা পূর্ববঙ্গ।
একাধিক বাধা-বিপত্তির কারণে একুশের (১৯৫২) তৎপরতা গড়াতে গড়াতে সুষ্ঠুরূপ ধারণ করে মার্চের শুরুতে। বিরাট প্রতিবাদ মিছিল শহর পরিক্রমা শেষ করে। স্লোগান ওঠে : ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি হয় নুরুল ইসলামসহ একাধিক ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে। আত্মগােপনে যেতে হয় এসব ছাত্রনেতাকে।
অবস্থা থিতিয়ে এলে ছাত্ররা সৈয়দপুর হাইস্কুল মাঠে ছােট একটি এক স্তম্ভের শহীদ মিনার তৈরি করে। এখানে ফুল ও ফুলমালা রেখে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। অবাঙালি ছাত্রদের হামলার সম্মুখীন হয় ছােট এ শহীদ মিনার। এমন সীমাবদ্ধতায় শেষ হয় সৈয়দপুরে ভাষা আন্দোলন।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক