You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে চাটমােহর
অসামান্য উদাহরণ ভাষাসংগ্রামী স্কুলছাত্রের

চাটমােহর তৎকালীন পাবনা জেলার প্রায় অপরিচিত একটি এলাকা, কিন্তু একুশের ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে। এ আন্দোলনের মূল কুশীলবেরা স্থানীয় হাইস্কুলের রাজনীতিমনস্ক ছাত্র। মাতৃভাষার প্রতি তাদের অনুরাগ প্রতিবাদ সংঘটিত করে মিছিল নিয়ে তাদের পথে নামতে উদ্বুদ্ধ করে। শহর পাবনায় সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা ও গুরুত্ব সম্ভবত তাদের প্রভাবিত করে থাকবে।
এখানেও আন্দোলনের তীব্রতা তৈরিতে সেই একই কাহিনি—অর্থাৎ ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঘােষিত কর্মসূচি পালন এবং পুলিশের গুলিতে ঢাকায় ছাত্র-জনতার মৃত্যু চাটমােহরবাসী ছাত্র-জনতার মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। খবর আসে জেলা শহর পাবনা থেকেও।
প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি চাটমােহর হাইস্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে পথে নেমে আসে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের উদ্যোগে স্কুলের কদমতলার মাঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষক গৌরচন্দ্র সরকার। এ সভায় উপস্থিত নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য আবদুল লতিফ সরকার, ওমর আলী, ইছহাক, দীপু সরকার, আবদুল হামিদ সরকার, আবদুর রহিম সরকার, হাবিবুর রহমান, মমতাজ খতিব, আবুল হােসেন প্রমুখ। এরা হাইস্কুলের নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র।
অভাবিত মনে হলেও ঘটনা সত্য যে এদেরই উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেদিনের সভায় গৌরচন্দ্র সরকারকে সভাপতি ও আবুল হােসেনকে সম্পাদক মনােনীত করে আন্দোলন পরিচালনার জন্য ১১ সদস্যের একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সভায় লাগাতার ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে ইতিপূর্বে পাবনা শহর থেকে কয়েকজন ছাত্রনেতা চাটমােহর ঘুরে যান ছাত্রদের সংগঠিতভাবে আন্দোলন পরিচালনার জন্য পরামর্শ দিতে।
সংক্ষিপ্ত সভা শেষে ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল পথে বের হয়। মিছিলটি বালুচর খেলার মাঠে এলে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মিছিলে যোগ দেন। তাতে আরও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য দেওয়ান আফজল হােসেন, মীর্জা আবদুল কাদের, কেরামত উদ্দিন আহমেদ, আজাহার সরকার, আজগর উদ্দিন আহমদ, ওসমান গনি, কার্তিক চন্দ্র কুণ্ড, ক্ষিতীশচন্দ্র কুণ্ডু, কৃষ্ণ কুণ্ডু প্রমুখ।
খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন ময়েন উদ্দিন মােল্লা। সভায় বক্তারা ঢাকার ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আদায়ের শপথ নেন। সভায় স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘খুনি নুরুল আমিনের পদত্যাগ চাই’ ইত্যাদি। ইতিপূর্বে গৃহীত লাগাতার ছাত্রধর্মঘটের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায় বৃহত্তর এই জনসভা।
সভা শেষে আবারও প্রতিবাদী মিছিলের পথপরিক্রমা। স্লোগানমুখর এই মিছিল থানার মােড়ে এসে একটি পথসভা করে। সেখান থেকে মিছিলটি রেলওয়ে স্টেশন অবধি গিয়ে যাত্রার ইতি টানে। এবং ছাত্রনেতাদের অনেকে ট্রেনে ভাঙ্গুড়ার দিকে যাত্রা করেন আন্দোলনের বিস্তার ঘটাতে।
পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি, শনিবার। পূর্ব সিদ্ধান্ত মাফিক হাইস্কুলের ছাত্ররা যথারীতি ক্লাস বর্জন করে মিছিলের জন্য স্কুলের পাশে সমবেত হয়। সভা শেষে মিছিলের যাত্রা শুরু করার সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক খন্দকার তােফাজ্জল হােসেনের কাছ থেকে বার্তা পেয়ে চাটমােহর থানার ওসিসহ একদল পুলিশ মিছিল করতে বাধা দেয়। এবং সরকারবিরােধী তৎপরতার অভিযােগে গৌরচন্দ্র সরকার, আবদুর রহিম সরকার, আবদুল হামিদ সরকার, মমতাজ খতিব, হাবিবুর রহমান, আবদুস সালামসহ প্রধান ছাত্রনেতা আবুল হােসেনকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে অবশ্য আটক আটজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি হাইস্কুলের কদমতলায় আবারও ছাত্রদের প্রতিবাদী সভা, সভাপতি শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরী। সভার মূল বিষয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি এবং ছাত্র হত্যার বিচার। সে মােতাবেক উচ্চারিত হয় স্লোগান, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। সভা শেষে মিছিল আর স্লোগান। মিছিল থানার মােড় অবধি আসায় ছাত্রনেতা আবুল হােসেন ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি ঘােষণা করেন। হাতে লেখা কর্মসূচির একটি কপি পাবনা জেলা সংগ্রাম কমিটির কাছে পাঠানাে হয়।
চাটমােহরে এভাবেই আন্দোলন চলে প্রতিবাদ সভার অনুষ্ঠান এবং স্লোগানমুখর মিছিলের পথপরিক্রমায়। লক্ষ করার বিষয় যে অখ্যাত ছােট্ট জনপদ (এলাকা বলাই সঠিক) চাটমােহরে স্কুলছাত্রদের তৎপরতায় অনুষ্ঠিত একুশের আন্দোলন চরিত্র বিচারে ছিল শহুরে আন্দোলনের মতােই, জনসংখ্যার বিচারে আয়তনে যদিও ছােট। স্কুলছাত্রদের এ আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছাত্রনেতা আবুল হােসেনের শ্রমনিষ্ঠ আন্তরিকতা। পুলিশ তা ঠিকই বুঝেছিল।
তাই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ আবুল হােসেনকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন তাকে পাবনা জেলহাজতে পাঠানাে হয়। সেখানে এক মাস কারাবাসের পর এই স্কুলছাত্রটিকে রাজশাহী জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। আট দিন পর মুক্তি। কিন্তু তার পড়াশােনার এখানেই ইতি। কারণ স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে নতুন করে ভর্তি হওয়ার পক্ষে বন্ড (মুচলেকা) দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। অর্থাৎ কোনাে প্রকার আন্দোলন না করার শর্ত।
ওই কিশাের বয়সেও আবুল হােসেন মুচলেকা দিতে রাজি হননি। ফলে শিক্ষার দরজা তার জন্য চিরদিনের মতাে বন্ধ হয়ে যায়। সাংবাদিক আবদুল মান্নান পলাশের প্রতিবেদনে জানা যায়, বয়স্ক, সংসারী আবুল হােসেন একজন গ্রাম্য ডাক্তারের পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন। দারিদ্র্য ও অসচ্ছলতা জীবনের নিত্যসঙ্গী। একুশের ভাষা আন্দোলন এই উপহারই তাকে দিয়েছে। দিয়েছে তার সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে অভাব-অনটনের জীবন।
রাজশাহী জেলে তখন পাবনার ভাষাসংগ্রামীদের অনেকে বন্দী জীবন যাপন করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে তার দেখা হয়। তারা সবাই পরবর্তীকালে পরিণত বয়সে উচ্চমান জীবন যাপন করেছেন এবং করছেন। কিন্তু অখ্যাত চাটমােহরের আদর্শনিষ্ঠ ভাষাসংগ্রামী আবুল হােসেনকে এবং দু-একজন সহপাঠীকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে, সম্ভবত শ্রেণিবৈষম্যের কারণে। বিশেষ করে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অমানবিক আচরণের কারণে।
একুশের ভাষা আন্দোলন নিয়ে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, এমনকি শাসকশ্রেণিতে গর্ব ও অহংকারের সীমা নেই। কিন্তু রাষ্ট্র ও শাসনযন্ত্র ভাষাসংগ্রামী আবুল হােসেনদের গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা সত্ত্বেও তাঁদের প্রতি দায় পালন করেনি। শ্রেণিবৈষম্য এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। একই রকম পরিণতি গাইবান্ধার মুক্তিযােদ্ধা হেলালউদ্দিনের মতাে সহযােদ্ধাদের। স্বাধীন বাংলাদেশ এই নিম্নবর্গীয় যােদ্ধাদের কোনাে প্রকার সহায়তা দেয়নি। অথচ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা বিত্তবান ভাষাসংগ্রামী মুক্তিযােদ্ধাদের জীবন অনেক উঁচু ডালে বাঁধা।
ইতিহাস এমন ধারার নিম্নবর্গীয় জাতীয় যােদ্ধাদের (ভাষাসংগ্রামী বা মুক্তিযােদ্ধা) মনে রাখেনি। ইতিহাসের চরিত্র সর্বজনীন।
পাবনার প্রত্যন্ত অঞ্চল চাটমোহরে একুশের ভাষা আন্দোলনে যারা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বিচারে কেউ যেমন বামপন্থী বা কমিউনিষ্ট (যেমন শুরুতে অমূল্য লাহিড়ী), তেমন অনেকেই নির্দলীয় ভাষানুরাগী ছাত্র। এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকায় হাইস্কুল ছাত্র আবল হােসেন এবং শিক্ষক নারায়ণচন্দ্র চৌধুরী। সেই সঙ্গে উল্লেখ্য এলাকার পূর্বোক্ত বিশিষ্টজন। এঁরাই প্রত্যন্ত এলাকায় একুশের ভাষা আন্দোলনকে সাফল্যে পৌছে দিয়ে জনমানসে মাতৃভাষাবিষয়ক সচেতনতা গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এঁরা জাতির জন্য গৌরবের প্রতীক, যদিও প্রান্তিক এলাকাবাসী ভাষাসংগ্রামীদের অধিকাংশই অবহেলিত, ইতিহাসে অচেনা ও অস্বীকৃত এক চাটমােহর নয়, বহু চাটমােহরতুল্য এলাকা তার প্রমাণ ও উদাহরণ।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!