ভাষা আন্দোলনে গােবিন্দগঞ্জ
অখ্যাত জনপদে একুশের মহামিছিল
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন সূত্র ও ইতিহাস পাঠ থেকে জানা যায় যে আটচল্লিশের মার্চের ভাষা আন্দোলন ঢাকার বাইরে প্রদেশের বিভিন্ন শহরে বিস্তার লাভ করলেও তা ছিল সীমাবদ্ধ বৃত্তে বাঁধা। একই সূত্রের ভিত্তিতে নিশ্চিত বলা চলে যে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির আন্দোলন সে তুলনায় থানা, ইউনিয়ন হয়ে দূর গ্রামের শিক্ষায়তন পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলনে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। একুশের জাতীয় চরিত্র গড়ে ওঠে শ্রেণি ও সম্প্রদায়-নির্বিশেষ রূপ নিয়ে।
সর্বজনীন চরিত্রের বলেই একুশের উত্তাপ দূর উত্তরের গােবিন্দগঞ্জকেও স্পর্শ করে। ছাত্র-জনতা প্রতিবাদী স্লোগান নিয়ে পথে নামে। যেমন জেলা শহর রাজশাহী বা রংপুরে, তেমনি একই চরিত্রে উদ্বুদ্ধ রংপুর জেলার অন্তর্গত গােবিন্দগঞ্জ থানার ছাত্র-জনতা। ভাষিক আবেগে উদ্বেল হয়ে তারা সরকারি অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সক্রিয় হয়। স্লোগান ওঠে : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
ভাষা আন্দোলন একুশের বিস্তারিত বিব্রণ পর্যালােচনায় দেখা যায়, এই আন্দোলন ছাত্রদের হাতে শুরু হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে পেরেছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে কৃষকদের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কৃষকশ্রেণির একাংশ সদলবলে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, মিছিলে যােগ দিয়েছে। ইতিহাস বলে, অভিজ্ঞতা বলে, এমন ঘটনা উত্তরবঙ্গের একাধিক দূর-জনপদেও দেখা গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে শ্রমিকও একই পথের যাত্রী।
গাইবান্ধা বা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতাে গােবিন্দগঞ্জেও শ্রমজীবী মানুষ ভাষা আন্দোলনে শরিক। একুশের বৈশিষ্ট্য হলাে, আন্দোলন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আশ্চর্য এক জাদুর টানে তা আশপাশে ছড়িয়ে গেছে, যদিও এর প্রধান উৎস স্কুল বা কলেজের মতাে শিক্ষায়তন। ছাত্রছাত্রীদের আবেগট তৎপরতায় একুশের উত্তাপ সঞ্চারিত সবখানে।
গােবিন্দগঞ্জ গাইবান্ধা মহকুমা শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়। আন্দোলন জেলা থেকে মহকুমা, সেখান থেকে থানা ও ইউনিয়নে ছড়িয়ে গেছে এমন ধারণা অনেকের। এ ধারণা আংশিক সত্য হলেও তথ্য বলে, প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্দোলন জন্ম নিয়েছে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের প্রেরণায়। নিকটবর্তী কেন্দ্রের প্রভাব সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যেমন দেখা যায় গােবিন্দগঞ্জে। এখানে স্থানীয় ছাত্রদের পাশাপাশি আন্দোলন তৈরিতে যুবলীগের মতাে সংগঠন বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আন্দোলনে প্রেরণা জোগাতে বিশেষ অবদান রাখেন প্রগতিবাদী রাজনীতির সংগঠক বারীন্দ্রনাথ দেব এবং তার সঙ্গে সক্রিয় ফারাজ মােল্লা, আলতাফ মণ্ডল প্রমুখ ভাষানুরাগী।
১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার অনুসরণে গােবিন্দগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে পতাকা দিবস পালন উপলক্ষে দেখা যায় এক বিশাল গণজমায়েত। সেখানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তেজক বক্তৃতা দেওয়া হয়। সভা শেষে দীর্ঘ মিছিলের পথপরিক্রমা। একুশের প্রস্তুতিপর্ব চলে সভা-সমাবেশ আর মিছিলে, স্লোগানে। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সূচনা ঘটায়।
ঢাকার বাইরে একাধিক দূর শহরের মতাে গােবিন্দগঞ্জ থানা শহরেও বাইশে ফেব্রুয়ারি খবর আসে ঢাকায় গুলিবর্ষণে হতাহতদের সম্পর্কে। ক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ, ক্ষুব্ধ জনসাধারণ। ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদসভার অনুষ্ঠান। সেখানে বেশ বড়সড় জমায়েত, সবারই প্রতিবাদী ও জ্বালাময়ী বক্তৃতা। সভা শেষে ছাত্রদের উদ্যোগে প্রতিবাদী মিছিল। বক্তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য পূর্বোক্ত শাহ ফজলে নুর রহমান, গােপাল মজুমদার, আলতাফ মণ্ডল, মাহবুবার রহমান, বারীন্দ্রনাথ দেব।
সেই মিছিলের উজ্জ্বল আকর্ষণ ভাষাবিষয়ক বর্ণমালাশােভিত ফেস্টুন। ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গেছে আশপাশের এলাকায়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এবং মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বিরােধী স্লোগানে চারদিক সচকিত হয়ে ওঠে। মিছিল এগিয়ে চলে থানার সার্কেল অফিসের দিকে। খবর পেয়ে আশপাশের এলাকা থেকে আগত কৃষক-জনতা মিছিলে যােগ দেয়’।
ছােট থানা শহর গােবিন্দগঞ্জ সেদিন মিছিলের শহর। কিছুটা হলেও তুলনা চলে বাইশে ফেব্রুয়ারির ঢাকার সঙ্গে, অন্তত চরিত্র বিচারের দিক থেকে তাে বটেই। তবে পার্থক্যও ছিল। ঢাকায় ছাত্র আন্দোলন ২২ ফেব্রুয়ারি গণআন্দোলনে পরিণত হয় প্রধানত পুরান ঢাকার মহল্লাবাসী তরুণ ও যুবাদের অংশগ্রহণে, আর গােবিন্দগঞ্জের ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনের চরিত্র অর্জন করে শ্রমজীবী কৃষকশ্রেণির উপস্থিতিতে। এ দুইয়ে ফারাক অনেক, বিশেষ করে রাজনৈতিক চরিত্র বিচারে। আন্দোলন আয়তনে ছােট হলেও গুণগত বিচারে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
এখানেও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক চেতনার কিছু মানুষ এবং সরকারি পেটোয়াদের চেষ্টা ছিল আন্দোলন বানচাল করা শক্তি প্রয়ােগে ও অপপ্রচারে। কিন্তু প্রগতিশীল ছাত্র-জনতার সম্মিলিত শক্তি সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। কোনাে অঘটনও ঘটেনি। পূর্ব বাংলার একটি ছােট প্রান্তিক এলাকায় ভাষা আন্দোলনের উত্তেজক তীব্রতা, এর সামাজিক ব্যাপকতা নিঃসন্দেহে এর জাতীয় চরিত্রের পরিচয় তুলে ধরে।
গােবিন্দগঞ্জের মতাে একটি ছােটখাটো জনপদে একুশের ভাষা আন্দোলনের এতটা তীব্রতা ও গণসংশ্লিষ্টতার প্রধান কারণ যেমন স্থানীয় রাজনৈতিক প্রগতিবাদী পরিবেশ, তেমনি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অনুরূপ প্রভাব। দুই জেলা রংপুর ও দিনাজপুর ছিল ১৯৪৬ সাল থেকে তেভাগা আন্দোলনের উগ্ররাজনৈতিক তৎপরতায় চঞ্চল, ফ্যাসিস্ট সরকার বিরােধিতার আত্মত্যাগে স্মরণীয়।
এসব ঘটনার রাজনৈতিক প্রভাব গােবিন্দগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাহায্য করেছিল। এখানে ভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নেতা-কর্মীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। প্রগতিশীল ধারার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এই যুবলীগ গঠিত হয় জামিলুর রহমান ও শাহ ফজলুর রহমানের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে (প্রতিবেদক : বিষ্ণু নন্দী)। এ আন্দোলনের প্রধান সংগঠক বারীন্দ্রনাথ দেবের বক্তব্যে জানা যায় স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আন্দোলন টিকিয়ে রাখতে ছাত্রদের অর্থ সাহায্য করেছেন। যেমন সমাজসেবাব্রতী সৈয়দ আলী প্রধান, আলামত আলী প্রমুখ ভাষানুরাগী ব্যক্তি।
স্থানীয় কৃষকনেতাদের মধ্যে কেউ কেউ ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলেছেন আন্দোলন পরিচালনায় সংগঠকদের তাত্ত্বিক পরামর্শদানের উদ্দেশ্যে। বুঝতে পারা যায়, গােবিন্দগঞ্জের মতাে একটি থানা শহরের ভাষা আন্দোলনটি ছিল রাজনৈতিক তাৎপর্যে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা-আন্দোলনের চরিত্র বিচারে এমন ঘটনা একাধিক এলাকায় দেখা গেছে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক