ভাষা আন্দোলনে চাপাইনবাবগঞ্জ
ছাত্রমিছিলে জনতার ঢল
অনুন্নত উত্তরবঙ্গ, অবহেলিত উত্তরবঙ্গ। উত্তরবঙ্গবাসীর কারও কারও এমন অভিযােগ পঞ্চাশের দশকেই শােনা গিয়েছে, বিশেষ করে রাজনীতিসচেতন ছাত্র-অছাত্রের কথায়। সে অভিযােগ শুনেছি ১৯৭২-এ তৎকালীন মন্ত্রী মফিজ চৌধুরীর কণ্ঠেও। একটু হালকা হাসি নিয়েই বলতেন, উন্নয়নের খাতিরে আমাদের ‘পদ্মা প্রদেশ’ চাই। উত্তরবঙ্গকে প্রদেশ হিসেবে ঘােষণার দাবি স্বাধীন বাংলাদেশে। তা-ও আবার একজন আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর মুখে। বিস্ময়কর সন্দেহ নেই। তবে সেখানে শ্রেণিবিশেষ যে অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নতই ছিল, তা বােঝা যেত ওই অঞ্চল থেকে ঢাকায় পড়তে আসা মেডিকেল ছাত্রদের রমরমা চলাফেরা দেখে। অবশ্য যাতায়াতব্যবস্থা তখন শােচনীয়ই ছিল, যেমন ছিল পূর্ববঙ্গের একাধিক অঞ্চলে।
কিন্তু একটি দিক থেকে উত্তরবঙ্গ পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু জেলা থেকে এগিয়ে ছিল, এমন দাবি অমূলক নয়; আর সেটা রাজনীতির ক্ষেত্রে। সব কটি জেলা বা মহকুমা না হলেও বেশ কয়েকটির ক্ষেত্রে এমন দাবি খাটে। দূর উত্তর-পশ্চিমের একাধিক জেলা, মহকুমা বা থানা এলাকার মতােই চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা সম্বন্ধে এ কথা সত্য। বিশেষ করে কৃষক রাজনীতি ও তেভাগা আন্দোলন নিয়ে তাে বটেই। চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের কৃষক আন্দোলনের সংগ্রামী নেতা রমেন মিত্র, কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্রের কথা বলা যায়, তেমনি আরও অনেকের কথা বলা যায়, যাদের জীবন ও কর্ম দৃষ্টান্তস্থানীয়। দুই, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও একই কথা খাটে। পূর্ববঙ্গের জেলা বা মহকুমা থেকে পিছিয়ে ছিল না উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহর বা গঞ্জ, বরং আন্দোলনের চরিত্রধর্মে কোনাে কোনাে এলাকা এগিয়ে ছিল পূর্বাঞ্চল থেকে, বিশেষ করে সচেতন জনসংশ্লিষ্টতায়। আগে লেখা সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে তা স্পষ্ট। স্পষ্ট বাম রাজনৈতিক আন্দোলনে এগিয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনাে এলাকার বিবেচনায়।
আটচল্লিশের মার্চের ভাষা আন্দোলন প্রদেশের সর্বত্র জমজমাট না হলেও কোনাে কোনাে শহরে তা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, যেমন যশাের। ঢাকায় ঘােষিত মার্চের কর্মসূচি বাস্তবায়নে চাপাইনবাবগঞ্জের ছিল বিশেষ ভূমিকা। মাযহারুল ইসলাম তরুর ভাষ্যমতে, ‘ঢাকা থেকে বেশ কিছু প্রচারপত্র নবাবগঞ্জে এসে পৌছায়।’ আমার ধারণা, ওই সময় আন্দোলনের কোনাে কোনাে নেতার বিশেষ তৎপরতায় ঢাকার বাইরে আন্দোলন সংগঠিত করার প্রচেষ্টায় এমনটা ঘটে থাকবে। বায়ান্নর আন্দোলনেও আমার জানামতে এমনটা ঘটেছে। যেমন একুশের আন্দোলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী আমার এক সহপাঠী মােল্লা খবিরউদ্দিন বেশ কিছু ইশতেহার ও পােস্টার নিয়ে নিজ এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে গিয়েছিল সেখানকার আন্দোলনে জ্বালানি যােগ করতে। সঙ্গে ছিল আরেক সহপাঠী বন্ধু হুমায়ুন হাই। সেটা অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা এবং ছাত্রদের হল ত্যাগ করতে বাধ্য করার পরিপ্রেক্ষিতে।
যা-ই হােক, আটচল্লিশের মার্চে পূর্বকথিত ইশতেহারগুলাে স্থানীয় আন্দোলনে কিছুটা হলেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রদের মনে উদ্দীপনা সঞ্চারিত করেছে। ১১ মার্চ ভাের থেকেই ছাত্ররা রাস্তায় বেরিয়েছে। তাদের প্রিয় স্লোগানগুলাে মুখে নিয়ে, বিশেষ করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এর আবেগ-স্পন্দিত স্বরগ্রামে। শিক্ষায়তনে যথারীতি ধর্মঘট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে সময়কার পাকিস্তানি মৌতাত সত্ত্বেও বেশ কিছুসংখ্যক রাজনীতিসচেতন মানুষ ছাত্রদের এ তৎপরতার সমর্থনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। যােগ দেন মিছিল ও সভা-সমাবেশে। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় হরিমােহন হাই স্কুলের ছাত্ররা।
এসব দেখেই সম্ভবত তখনকার হিসাবমাফিক মুসলিম লীগ রাজনীতিক ও সমর্থকদের যথারীতি প্রচার—এ আন্দোলন পাকিস্তান ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে; এতে রয়েছে ভারতীয় ষড়যন্ত্র। এ অপপ্রচার গােটা প্রাদেশেই চলেছে। এমনকি বায়ান্নতে তা আরও তীব্র হয়েছে। লক্ষণীয়, চাপাইনবাবগঞ্জের বাংলা ভাষাপ্রেমী ছাত্র-জনতা ওই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়নি। এমনকি রাজশাহীতে মিছিলের ওপর সরকারি ছাত্রসংগঠনের মাস্তান বাহিনীর হামলার খবরেও হতােদ্যম হয়নি চাপাইনবাবগঞ্জের ভাষাকর্মীরা।
আটচল্লিশে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক ও পরিপূর্ণ প্রকাশ ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে। চাপাইনবাবগঞ্জ এদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। বরং দূরপ্রান্তিক এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এখানে রাজধানী ঢাকার মতােই আবেগ ও উত্তেজনা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছাত্রসমাজ একুশের কর্মসূচি সফল করে তুলতে পথে নামে। মুখে স্লোগান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’
ইতিমধ্যে ঢাকায় ছাত্রহত্যার খবর এসে পৌছানাের পর ক্রোধ, ঘৃণা ও আবেগ যুক্ত হয় ওই আন্দোলনে। নতুন স্লোগান : ‘নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই’, ‘মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করাে’ ইত্যাদি। আর এ সংবাদ বিদ্যুৎ-তরঙ্গের চরিত্র নিয়ে শহরের শিক্ষিত ও পেশাজীবী শ্রেণিসহ স্থানীয় জনসাধারণকে উদ্দীপ্ত করে। হঠাৎ করেই যেন গােটা শহর প্রতিবাদী শহরে রূপান্তরিত হয়। তীব্র সরকারবিরােধী মনােভাব নিয়ে মানুষ রাস্তায় নামে। আবেগ ও শোক একীভূত হয়ে ছাত্র-জনতার মনে প্রতিবাদী প্রেরণা সৃষ্টি করে।
শহরের চালচিত্রটি ঢাকার পরিস্থিতি থেকে ভিন্ন ছিল না এর সংখ্যাগত সীমিত চরিত্র সত্ত্বেও। রাস্তায় প্রতিবাদী স্লোগান মুখে ছাত্র-জনতা। কালো পতাকা, কালাে ব্যাজ শােকের ব্যঞ্জনা তৈরি করে। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিবাদী স্লোগান লেখা এবং লাল বর্ণমালার পােস্টার সাঁটা। অবস্থাদৃষ্টে পুলিশও তৎপর হয়ে ওঠে। হামলা চালায় মিছিলে, গ্রেপ্তার করে প্রধান ছাত্রনেতা মসিউল হককে। এ আন্দোলনে উল্লেখযােগ্য অন্যান্য ছাত্রনেতার মধ্যে ছিলেন গােলাম মােহাম্মদ, হাফিজুর রহমান, আবু সাঈদ, আবুল ফজল প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে আন্দোলন যথারীতি অব্যাহত থাকে।
প্রধান সংগঠক গ্রেপ্তার হওয়ার পরও উদ্যম হারায়নি ছাত্র-জনতা, থামেনি প্রতিবাদ মিছিল। শূন্যস্থান পূরণ করতে অসুবিধা হয়নি। বরং এ ঘটনা ছাত্রজনতাকে প্রতিবাদের প্রেরণা জোগায়। মিছিলে সাহস ও শক্তি সঞ্চারিত করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংঘটিত একুশের অন্যতম প্রধান ঘটনা কুতুবুল আলমসহ (স্বনামখ্যাত গম্ভীরা লােকসংগীতের গায়ক) কয়েকজনকে পুলিশের গ্রেপ্তার। এ খবর শহর ও অদূর এলাকার জনমনে ক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আন্দোলন আগুনের মতো ছড়িয়ে যায় নিকটবর্তী এলাকায়। আটক ছাত্রনেতাদের ও গম্ভীরাশিল্পীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন বিস্ফোরক চরিত্র অর্জন করে। পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এমন আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত প্রশাসন আটক সবাইকে মুক্তি দেয়।
চাপাইনবাবগঞ্জে আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে রাজশাহীর ছাত্রনেতা গােলাম আরিফ টিপু ব্যক্তিগত যােগাযােগসূত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। সঙ্গে রাজশাহী কলেজের দু-একজন ছাত্রনেতা। প্রসঙ্গত, রাজশাহী মেডিকেল স্কুলের ছাত্র মেসবাহুল হকও এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তৎপর ছিলেন। দুরাঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও চাপাইনবাবগঞ্জের ভাষা আন্দোলন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল। বিশেষ করে যখন সেখানকার কৃষকদের একাংশকে দেখা যায় লাঙলের মুঠি ছেড়ে ছাত্র-শিক্ষক ও জনতার সঙ্গে মিছিলে যোগ দিতে। এ ঘটনা স্থানীয় রাজনৈতিক চেতনারই পরিণাম। (আনােয়ার হােসেন দিলু, ভােরের কাগজ, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫)।
এভাবে চাপাইনবাবগঞ্জের ভাষা আন্দোলন্ত প্রকৃত অর্থে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়, যা অন্য অর্থে শ্রেণিনির্বিশেষ আন্দোলনও বটে। এ আন্দোলন ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী চলে। আন্দোলনের আরেক সংগ্রামী নেতা ওসমান গনি। এ আন্দোলনের সর্বজনীন চরিত্র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় যুক্ত করেছে।
উল্লেখ্য যে চাপাইনবাবগঞ্জের ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল একাধিক শিক্ষায়তনের ছাত্রনেতৃত্বের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। সংবাদ প্রতিবেদক আনােয়ার হােসেন দিলুর বিবরণ মতে:
‘চাপাইনবাবগঞ্জে একমাত্র কলেজ শিবগঞ্জ থানার দাদনচক (এ কে ফজলুল হক) কলেজ, দাদনচক হাইস্কুল, জিটি স্কুল (গুরু ট্রেনিং স্কুল), কলেজিয়েট হাই স্কুলের ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত ভাষা সংগ্রাম কমিটির ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া দেয় সাধারণ কৃষক-জনতা।…
‘ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২৪ ফেব্রুয়ারি তারা সারা দিন হালচাষ বন্ধ রাখে। ২৭ ফেব্রুয়ারি দাদনচক হাইস্কুল মাঠে সংগ্রাম কমিটির ভাকে বিরাট জনসভায় শয়ে শয়ে মানুষ যােগ দেয়। দাদনচক হাই মাদ্রাসার ছাত্র মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সেই ঐতিহাসিক জনসভা।’
আমরা আগেই বলেছি, একুশের আন্দোলন প্রদেশের গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা। ওই প্রতিবেদকের ভাষায়, প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত, বিচ্ছিন্ন এক অঞ্চল—পদ্মা নদীর চরাঞ্চল নারায়ণপুর গ্রামের পথ মুখরিত মিছিলের স্লোগানে। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন নারায়ণপুর হাইস্কুলের ছাত্র বাহার ও শিক্ষক সাইফুদ্দিন।
খােদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে অবস্থিত হরিমােহন হাইস্কুলের ছাত্রদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। এখানে আন্দোলন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন ওই স্কুলের ছাত্রনেতা আবুল হােসেন, পুলিশ যাকে মিছিল থেকে তুলে নিয়ে যায়। একইভাবে ক্লাস বর্জন করে, ধর্মঘট পালন করে আন্দোলনে যােগ দেয় শিবগঞ্জ ও রানীগঞ্জ হাইস্কুলের ছাত্ররা। ভিন্নমত প্রসঙ্গে চাপাইনবাবগঞ্জের সন্তান রাজশাহী কলেজের তত্ত্বালীন প্রগতিশীল ছাত্রনেতা গােলাম আরিফের মন্তব্য, ‘তখন নবাবগঞ্জেও একটি কলেজ ছিল, শুধু দাদনচকেই নয়।’
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক