You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়া - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়া
দূর উত্তরের এলাকাও উত্তপ্ত

পূর্ববঙ্গের উত্তরাঞ্চলেরও উত্তরের জেলা দিনাজপুর বিভাগ-পূর্বকাল থেকে কৃষক আন্দোলন ও বাম রাজনীতির প্রধান জনপদ হিসেবে খ্যাত। এ ছাড়া ছিল তেভাগা আন্দোলনের ঘনঘটা। জলপাইগুড়ি-সংলগ্ন এর উত্তরাঞ্চলের থানাগুলাে অর্থাৎ পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, বােদা, দেবীগঞ্জ। স্বভাবতই রাজনীতিমনস্ক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত, যদিও তা উত্তরের দূর প্রান্তের যােগাযােগ বিচারে সুগম্য নয়।
এ প্রান্তিক অঞ্চলের রাজনৈতিক আন্দোলনে খ্যাতিমান ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ পরিচিত নাম কৃষক নেতা হাজী মােহাম্মদ দানেশ, তরুণ কমিউনিস্ট নেতা মােহাম্মদ ফরহাদ, জাতীয়তাবাদী (শুরুতে প্রগতিবাদী) মীর্জা গােলাম হাফিজ প্রমুখ। এ অঞ্চলের সন্তান, কিন্তু অন্যত্র পাঠরত কলেজছাত্র নেতা মােহাম্মদ সুলতান, গােলাম রহমান, দবিরুল ইসলাম প্রমুখও উল্লেখযােগ্য।
এঁরা নানাভাবে এ প্রান্তিক অঞ্চলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভিত তৈরিতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু এ অঞ্চলে দেশবিভাগ উপলক্ষে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে বলা বাহুল্য এখানে মুসলিম লীগ রাজনীতির প্রভাব ছিল যথেষ্ট বিশেষ করে শাসনদণ্ডের সমর্থনের কারণে। তবু সাজ্জাদুর রহমানের ভাষায় ‘জনবিরল পঞ্চগড়েও ভাষা আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল।’ বলা বাহুল্য যে পঞ্চগড় নামটি ইতিহাসগন্ধি। একই সূত্রে প্রকাশ যে পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়া এবং বােদা, দেবীগঞ্জে ভাষা আন্দোলন স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়। শেষােক্ত এলাকায় ছিল বাম রাজনীতির প্রাধান্য। আন্দোলনের প্রবণতা ছিল অধিক। এর প্রভাব পড়েছে পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়ার ভাষা আন্দোলনে। এ ছাড়া এখানে যাতায়াত ছিল পূর্বোক্ত বাম রাজনৈতিক নেতাদের।
উল্লিখিত অঞ্চলে সম্ভবত যােগাযােগ দুর্গমতার কারণে ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন সংগঠিত রূপে প্রকাশ পায়নি। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতা দু-একজনের স্মৃতিচারণায় দেখা যায়, এ সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ মিছিল বা সভা ছাত্রদের তৎপরতায় সংঘটিত হয়েছে।
তবে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা সুস্পষ্ট রূপ গ্রহণ করে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচির সূত্রে এবং বিশেষভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতার হত্যার সংবাদে।
পঞ্চগড় অঞ্চলের ছাত্রসমাজ সূচিত ভাষা আন্দোলনের চরিত্র ছিল শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট, মিছিল, সভা, কখনাে পিকেটিং ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ। তবে এতে জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ বিশেষ ছিল না, নীরব সমর্থন ছিল এমন ধারণা (নাজমুল হক, আঞ্চলিক ইতিহাস) সম্ভবত বাস্তববাচিত নয়।
কারণ, ঢাকায় রক্তঝরার প্রতিক্রিয়ায় দুর্গম টেকনাফ, রামু বা দূর সুনামগঞ্জ বা অনুরূপ সাতক্ষীরায় একুশের আন্দোলন যথারীতি ছাত্র-জনতার আন্দোলন রূপে সংঘটিত হয়েছে। এমনকি ঠাকুরগাঁওয়ের মতাে প্রত্যন্ত এলাকায়ও। সেসব ক্ষেত্রে ছিল জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কাজেই পঞ্চগড় অঞ্চলই-বা ব্যতিক্রম হবে কেন?
আমরা দেখেছি উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতাে এলাকার গ্রামাঞ্চলেও একুশের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া যেখানে কৃষক আন্দোলন ও বাম রাজনীতির প্রভাব রয়েছে, সেখানে জনসাধারণ বা কৃষক- জনতার ভাষা আন্দোলনের মতাে একটি সর্বজনীন বিষয়ের প্রতিবাদী তৎপরতায় সক্রিয় সমর্থন জানানােই স্বাভাবিক ঘটনা।
হয়তাে তাই পূর্বোক্ত ভিন্ন সূত্রে ছাত্র-জনতার সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে একুশের ভাষা আন্দোলন উপলক্ষে। বলা হয়েছে পুলিশের মিছিলে হামলা এবং ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষের কথা। এমনকি উল্লিখিত হয়েছে শহরবাসী আইনজীবী, শিক্ষক ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কথা।
এ আন্দোলনে জনসংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে ইতিপূর্বে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলনের বিবরণে পঞ্চগড় তেঁতুলিয়ায় অনুষ্ঠিত জনসভার কথা বলা হয়েছে দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত সংবাদসূত্রে। এমনকি আজাদ-এ অন্য এক খবরে প্রামাণিকপাড়ায় অনুষ্ঠিত জনসভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে মওলানা এনায়েতপুরীর সমর্থনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
বস্তুত একুশের আন্দোলন গােটা পূর্ববঙ্গ প্রদেশে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার মতাে দূরতম এলাকায় বিস্তার লাভ করেছিল। এমনটিই ছিল একুশের বৈশিষ্ট্য।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক