You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে নরসিংদী - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে নরসিংদী
আন্দোলন মূলত ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে

নরসিংদী ঢাকা জেলার অন্তর্গত নারায়ণগঞ্জ মহকুমাধীন একটি থানা হলেও এই এলাকাটি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে ঢাকা মধুপুরগড় অঞ্চলের পুরাভূমির অন্তর্ভুক্ত, যে ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন। সন্নিহিত এলাকার থানাগুলাের রয়েছে রাজনৈতিক ঐতিহ্য, প্রগতিবাদী রাজনীতির তৎপরতা। যেমন রায়পুরা, শিবপুর, মনােহরদী। এ অঞ্চলে তাঁতশিল্পেরও খ্যাতি রয়েছে।
নরসিংদী শহরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ওই বাম রাজনীতির কারণে। এ এলাকা খ্যাত বাম আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। এ অঞ্চলের বিশাল মেঘনা নদীর এক পাড়ে ঢাকা জেলা, অন্য পাড়ে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মহকুমার একাধিক থানার অন্তর্গত অঞ্চল নিম্নভূমি।
নরসিংদীর যাতায়াতব্যবস্থা তখনাে সহজ ঢাকা থেকে ট্রেন যােগাযােগের কারণে। স্বভাবতই ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন নরসিংদীকেও স্পর্শ করে। একদিকে যেমন প্রগতিবাদী আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, তেমনি অন্যদিকে এ সময় পর্বে পাকিস্তানি প্রশাসনের দমননীতির উগ্রতা। ফলে এ পর্বের আন্দোলন আকাঙ্ক্ষিত সাংগঠনিক সংঘবদ্ধ বলিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে শেষ হয়েছে ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন। ঢাকায় এ আন্দোলন শাসনযন্ত্রের সঙ্গে আপসবাদে স্থগিত হয়ে যায় ১৫ মার্চের পর থেকে।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা বা অনুরূপ রচনার বড় সমস্যা যুক্তিহীন আবেগ এবং বিস্মৃতিচারণার ভুলভ্রান্তি, বিশেষত দিন-তারিখ ও ঘটনার তথ্যাবলিতে। ১৯৪৮ প্রসঙ্গে এ ত্রুটি অধিকতর। নরসিংদীর তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে এখানকার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনায়ও উল্লিখিত ত্রুটি কমবেশি লক্ষ করা যায়।
১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে অবশ্য অবস্থা ভিন্ন, দেশের অন্যান্য শহরের মতােই। যে শহর ১৯৪৮-এর মার্চে নিস্তরঙ্গ বা বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভে আন্দোলিত, তেমন প্রতিটি শহরে দেখা গেছে ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল এবং অনুরূপ জনসভা ও সমাবেশ। স্বভাবতই নরসিংদী ব্যতিক্রম হবে কেন? তাই ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয়।
এ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিরা হচ্ছেন মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আবদুল হালিম, আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া, রমিজ উদ্দিন ভূঁইয়া, সামাদ মৌলভী ও চাঁদ মিয়া (এম আর মাহবুব)। ভিন্ন সূত্রে আন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন উল্লিখিত ব্যক্তিরা ছাড়াও আবুল হাশিম মিয়া, করিম মিয়া, কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া প্রমুখ।
(মােহাম্মদ মাহবুবুল আলম কিরণ)। উভয় সূত্রে প্রকাশ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক পুলিশি প্রহরার কারণে বিক্ষোভ মিছিল ছিল পুরােপুরি শান্তিপূর্ণ। দোকানপাট বন্ধ রাখতে জোরজবরদস্তি করা হয়নি। দুপুরের পর থেকে জনজীবন মােটামুটি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
এদিন বিকেলে ঈদগাঁও ময়দানে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় সভাপতিত্ব করেন আফসার উদ্দিন সরকার (শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি)। নরসিংদীতে ভাষা আন্দোলনের তৎপরতা চলেছে মার্চের প্রথম সপ্তাহ অবধি। দৈনিক আজাদ-এর একটি সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা যায় :
‘৫ই মার্চ নরসিংদীতে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। স্থানীয় স্কুল দোকানপট সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। বেলা ১২টায় ছাত্রদের এক মাইল লম্বা এক শােভাযাত্রা বাহির হয়। অপরাহ্নে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ঢাকায় পুলিশের গুলী বর্ষণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত আটক বন্দীদের মুক্তি দাবী করা হয়। ( আজাদ, ৮ মার্চ ১৯৫২)
আমরা ইতিপূর্বে ঢাকায় ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি যে, নরসিংদীর সন্নিহিত ও অদূরবর্তী এলাকাগুলােতে ভাষা আন্দোলন যথারীতি সংঘটিত হয়। যেমন রায়পুরা, শিবপুর, হাতিরদিয়া, মনােহরদী প্রভৃতি এলাকা।
নরসিংদীতে একুশের ভাষা আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রাখে স্থানীয় কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররা। নরসিংদীতে প্রথম শহীদ মিনার তৈরির সময় (বছর) নিয়ে যথেষ্ট ভিন্নমত হয়েছে। কারও মতে নির্মাণ বছর ১৯৫৩ (এম আর মাহবুব), কারও তথ্যে ১৯৫৪ (পূর্বোক্ত মাহবুবুল আলম কিরণ), অন্যদিকে দৈনিক ইত্তেফাক-এর ভাষ্যমতে নরসিংদীতে প্রথম শহীদ মিনারের প্রতিষ্ঠা ১৯৬২ সালে।
আসলে ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় প্রবল অবহেলার কারণে যেমন সেসব বিবরণে তথ্য বিকৃতি ঘটেছে ঘটনাবলির ক্ষেত্রে, তেমনি ঘটেছে শহীদ মিনার তৈরির সময় নিয়েও।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক