You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে পাঁচবিবি ও আক্কেলপুর
বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ইতিহাস রচনা

বাম রাজনীতি ও কৃষক রাজনীতির অন্যতম ঘাঁটি পাঁচবিবি ও আক্কেলপুর, আপন কর্মে তাদের খ্যাতি। বিভাগপূর্বকাল থেকে এ দুই এলাকা পূর্বোক্ত রাজনীতির শক্ত ঘাঁটি। এ অঞ্চলে, বিশেষ করে বামধারায় প্রভাবিত কৃষক আন্দোলনের ভিত গড়ে তােলার ক্ষেত্রে সে সময় স্বাধীনতাসংগ্রামী ডা. আবদুল কাদের চৌধুরীর অবদান প্রবাদপ্রতিম। বিভাগ-উত্তর সময়ে পাঁচবিবির নাম বারবার রাজনীতিতে উঠে আসে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক তৎপরতায়, যে রাজনীতি মূলত কৃষক ও নিম্নবর্গীয়দের কল্যাণে নিয়ােজিত।
পাঁচবিবি-আক্কেলপুর এলাকায় ভাষা আন্দোলন গড়ে তােলার অন্যতম প্রধান কারিগর আক্কেলপুর নিবাসী, বগুড়া আজিজুল হক কলেজের জ্যেষ্ঠ ছাত্র কবি আতাউর রহমান। তিনি প্রগতিশীল বাম রাজনীতিরও সক্রিয় সদস্য।
তাঁর ও অন্য সহযােগীদের চেষ্টায় এই এলাকার বিভিন্ন স্তরের ছাত্ররা আন্দোলন সফল করে তুলতে সংগঠিত হন। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে যুবলীগের ছিল বিশেষ ভূমিকা। আতাউর রহমান ছিলেন বগুড়া জেলা যুবলীগের সভাপতি।
বগুড়াকেন্দ্রিক রাজনীতি পাঁচবিবি-আক্কেলপুরের রাজনৈতিক তৎপরতা প্রভাবিত করলেও এদের আদর্শিক বৈশিষ্ট্য বাম ধারার। তা ছাড়া নিজস্ব সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল যথেষ্ট। স্থানীয় সূত্রে সুজন হাজারী লিখেছেন, বামপন্থী রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রসর কমিউনিস্টদের শক্ত ঘাঁটি নামে পরিচিত পাঁচবিবি এবং আক্কেলপুরের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাঁচবিবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্থানীয় বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
কমিউনিস্ট নেতা নজিরউদ্দীন মণ্ডল, কামালউদ্দীন মণ্ডল, নেপথ্যে ডা. আব্দুল কাদের চৌধুরীসহ একাধিক বাম বা গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনীতিমনস্ক মানুষ পাঁচবিবিতে ভাষা আন্দোলন শক্তিশালী করে তুলতে এগিয়ে আসেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিরা হচ্ছেন শুকুর আলী মণ্ডল, মেছের আলী, অধীরচন্দ্র সাহা, অরবিন্দ কুণ্ডু. মনসুর আলী ফকির, নঈমউদ্দীন মােল্লা, রকিব মাস্টার, মনিরউদ্দিন প্রমুখ।
পাঁচবিবির ভাষা আন্দোলনে লালবিহারী হাইস্কুলের ছাত্ররা প্রধান ভূমিকা পালন করে। ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মীর শহীদ মণ্ডল, আবুল খালেদ, মজিবউদ্দীন মণ্ডল, আমানউল্লাহ, আমিনুর রহমান প্রমুখ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। এ ক্ষেত্রে আগে গঠিত স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিও ছিল তৎপর।
বলা বাহুল্য, স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের দাপটে এ অঞ্চলে ১৯৪৮ সালের মার্চের আন্দোলন সুস্পষ্ট রূপ নিতে পারেনি। কিন্তু ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর চরিত্রবদল প্রধানত পূর্বোক্ত কারণে। এ ক্ষেত্রে জনসমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সক্রিয় হয়ে ওঠে স্কুলছাত্র ও স্থানীয় যুবকেরা। ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের সংবাদ ছাত্র-যুবক ও জনমনে প্রবল সরকারবিরােধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সভা-সমাবেশ, মিছিল ও স্লোগানে পাঁচবিবি মুখর হয়ে ওঠে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়’, ‘পুলিশের জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি হয়ে ওঠে প্রধান স্লোগান।
অবশ্য এ আন্দোলনের সূচনা ঢাকায় ঘােষিত ১১ ফেব্রুয়ারির পতাকা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে। এর ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভাষার দাবি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির সুযােগ সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের ভাষিক তৎপরতার মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে গণসংযােগ, ইশতেহার বিলি ও প্রচার। এ ছাড়া ছােট ছােট সভা-সমাবেশ তাে রয়েছেই।
ঢাকা থেকে আসা সংবাদপত্র ছিল আন্দোলন-বিষয়ক খবর সরবরাহের প্রধান মাধ্যম। প্রদেশের অন্যান্য শহরের মতাে এ অঞ্চলেও ঢাকাভিত্তিক খবরাদি একুশের আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চার করে। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে সভা ও মিছিলের মাধ্যমে। ২৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচবিবিতে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জনসভা। সভাপতিত্ব করেন ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট কলিমুদ্দীন। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন স্থানীয় ছাত্রনেতা মীর শহীদউদ্দিন মণ্ডল। এদিন শিক্ষকদের উদ্যোগেও পৃথক একটি প্রতিবাদ সভা হয়। এখানকার আন্দোলনে স্কুলছাত্রদের পাশাপাশি কমিউনিস্ট ভাবধারায় প্রভাবিত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ (১৯৫১-তে গঠিত) নেতা-কর্মীদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
একই ধারায় আক্কেলপুরেও আন্দোলন শুরু ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ছাত্রধর্মঘট, ছাত্রসভা, মিছিল ও স্লোগানের মধ্য দিয়ে। ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন কবি আতাউর রহমান। ব্যতিক্রমী ঘটনা স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা মজিবর রহমানের উপস্থিতি এবং ঢাকায় গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে তার বক্ততা।
আক্কেলপুর থানা সদরে একুশের আন্দোলন গড়ে তুলতে অন্যদের সঙ্গে নেতৃত্বদানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন বামপন্থী নেতা ছমির উদ্দিন মণ্ডল। একাত্তরে তিনি পাকবাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করেন (সাংবাদিক সুজন হাজারী)। একই সঙ্গে আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন আবদুল খালেক, যুবলীগ নেতা প্রভাসচন্দ্র রায় প্রমুখ।
পাঁচবিবির মতাে আক্কেলপুরেও একুশের ভাষা আন্দোলন সুসংগঠিত ও সংহত রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আন্দোলন চলে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে। একুশের সর্বজনীন তৎপরতা এ এলাকায় বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনসংহতি ঘটাতে সাহায্য করে।
এভাবে একুশের আন্দোলন আক্কেলপুর থানা সদর থেকে এর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। একশের আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে। আক্কেলপুরে কবি আতাউর রহমানসহ আরও যাঁরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে বিশেষ উলেখযোগ্য হাশেম আলী খান, মনতেছের রহমান, আজিজার রহমান, প্রভাসচন্দ্র রায়, কাজী আবদুল বারী প্রমুখ বিশিষ্টজন। আক্কেলপুরেও গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, যা বিভিন্ন মত ও পথের লােকজনকে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হতে বা সমর্থন জানাতে সাহায্য করেছিল।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!