ভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার
সাগর অঞ্চল উত্তাল একুশের আন্দোলনে
কক্সবাজার সমুদ্র-সংলগ্ন অঞ্চল এবং বঙ্গীয় বর্মি (রাখাইন) মিশ্রভাষিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যে ধন্য। কক্সবাজারে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গ্রন্থের লেখক- গবেষক- সাংবাদিক মুহম্মদ নূরুল ইসলামের ভাষায়, কক্সবাজার নামটি মাত্র ২১৫ বছর পূর্বের। অর্থাৎ ১৮০০ সালের শুরুতে হয় এই নামকরণ। পূর্বে কক্সবাজারের একাধিক নাম ছিল বলে গবেষকদের অভিমত।…কক্সবাজারের বার্মিজ নাম “ফলাকি” বা “ফলাজি”।’
আরাকানসহ চট্টগ্রামের সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চল সম্ভবত ভৌগােলিক ও রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক টানাপােড়েন ও রক্তাক্ত নৈরাজ্যের শিকার। একালেও তার অবসান ঘটেনি। কিছুকাল থেকে রাখাইনে রােহিঙ্গা গণহত্যা এবং নির্যাতিত রােহিঙ্গাদের বৃহত্তর কক্সবাজার অঞ্চলে শরণার্থী জীবনযাপন তার উদাহরণ।
এমনই এক রাজ্য দখল ও উপদ্রবের কারণে ‘আরাকানের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ নাফ নদী অতিক্রম করে বর্তমান কক্সবাজার এলাকার নিরাপদ স্থানে চলে আসে।’ (মুহম্মদ নূরুল ইসলাম)। এদের নিরাপদ বসবাসের ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ভারতের ইংরেজ বণিক শাসক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। তারই নামানুসারে চট্টগ্রামের এই সমুদ্র ভাসান অঞ্চলের আধুনিক নাম কক্সবাজার।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলা প্রয়ােজন যে বর্তমান মিয়ানমারের সামরিক-বেসামরিক শাসনকর্তাদের যুক্তিহীন দাবি যে রাখাইন অঞ্চলের রােহিঙ্গারা চট্টগ্রামবাসী, তাই তাদের সেখানেই থাকা দরকার। এ দাবি একেবারেই গ্রহণযােগ্য নয়। এতদঞ্চলের পূর্ব ইতিহাস ভিন্ন কথাই বলে, যা তাদের অবাস্তব দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
যা-ই হােক, কক্সবাজার অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন অবস্থান দীর্ঘকাল যােগাযােগ ও যাতায়াত বিচারে দুর্গম হিসেবেই চিহ্নিত ছিল। এবং তা ইংরেজ শাসন আমলের উদাসীনতার কারণে। বিভাগােত্তর পাকিস্তান আমলও এদিক থেকে খুব একটা ব্যতিক্রম ছিল না, যদিও বর্তমানে অবস্থার অনেক উন্নতি ও পরিবর্তন ঘটেছে।
কক্সবাজার ওই পর্যায়ে চট্টগ্রাম জেলার একটি মহকুমা হিসেবে স্বীকৃত হলেও এ অঞ্চলের যােগাযােগব্যবস্থার কারণে সে সময় সামাজিক- সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত পর্যায়ের ছিল না। তেমনি শিক্ষাব্যবস্থা। এসব বাস্তবতার কারণে ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন কক্সবাজারকে স্পর্শ করতে পারেনি। সংবাদ আদান-প্রদানের সমস্যা এর বড় কারণ। স্বভাবতই এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল পুরােপুরি মুসলিম লীগ দল ও তাদের শাসনের প্রাধান্য। ছিল প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়াশীলতার দাপট।
এমন এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও স্থানীয় আইনজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবীদের প্রগতিশীল অংশ (হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে) তাঁদে আলাপ- আলােচনায় ভাষা আন্দোলন ও রাজনীতি বিষয়ক সচেতনতার পরিচয় রেখেছেন। তা ছাড়া চট্টগ্রাম থেকে মাঝেমধ্যে এসেছেন দু-একজন সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, যাঁদের আলােচনার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় ছাত্র ও শিক্ষক পেশাজীবী মহলে।
তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে কক্সবাজার মহকুমা শহরে একুশের (১৯৫২) ভাষা আন্দোলন উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ পাবে। এ পর্বে স্থানীয় হাইস্কল ও জুনিয়র স্কুলের ছাত্ররা ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক চেতনার উদাহরণ তৈরি করেছিল। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষকের ছিল প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সমর্থন।
কক্সবাজার সদর মহকুমা শহরের একাধিক স্কুলের ছাত্ররাই একুশের ভাষা আন্দোলনের প্রধান ঘটক। এদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন হাইস্কুলের ছাত্ররা। অবস্থানগত কারণে একুশের মর্মান্তিক ঘটনাবলির সংবাদ কক্সবাজারে দেরিতে পৌছায়। কিন্তু খবর জানার পর কচিকাঁচা স্কুলছাত্ররা সেদিন চুপচাপ বসে থাকেনি।
মূলত নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে ক্লাস বর্জন অর্থাৎ ধর্মঘট পালন, মিছিল, স্লোগানসহকারে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু করে। স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই’, ‘নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি। স্লোগানমুখর ছাত্রমিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে শহরের রাস্তায় তাদের প্রতিবাদী পরিক্রমা শেষ করে। মিছিল শেষে যথারীতি প্রতিবাদ সভা, বক্তৃতা এবং সরকারবিরােধী প্রস্তাব গ্রহণ।
কক্সবাজার হাইস্কুলে ছাত্রদের একুশের আন্দোলনে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র খালেদ মােশাররফ (একাত্তরের অন্যতম মুক্তিযােদ্ধা), আবদুল মাবুদ এখলাছী (দশম শ্রেণি) ও তার সহপাঠী শামসুল হুদা প্রমুখ। তাদের সঙ্গে ছিলেন অষ্টম-নবম শ্রেণির ছাত্র নুরুল হুদা চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরী, রফিক উল্লাহ, ছালেহ আহমদ, জালাল আহমদ, নাসির উদ্দিন, নিখিলেশ্বর চক্রবর্তী প্রমুখ আন্দোলনে সক্রিয় ছাত্ররা। (মুহম্মদ নূরুল ইসলাম)।
এ আন্দোলনের সূচনা ঘটে একাধিক সূত্রমতে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে। মহকুমা প্রশাসক মৌলভী গফুরুজ্জামান চৌধুরীর বাসায় আসা টেলিফোন বার্তার সুবাদে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে ঢাকার ছাত্র হত্যাকাণ্ডের খবর। মহকুমা প্রশাসক ছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার একজন সমর্থক। স্মর্তব্য যে স্থানীয় পুলিশ ও গােয়েন্দা বিভাগ ছিল আন্দোলনের ঘাের বিরােধী।
আন্দোলন শুরুর তারিখ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ পায় যখন সংশ্লিষ্ট লেখকদের সূত্রে দেখা যায় কক্সবাজার সদরের ঐতিহ্যবাহী ‘ঈদগাঁও হাইস্কুল’-এর ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি, সংবাদ দেরিতে আসার কারণে (মুহম্মদ নূরুল ইসলাম)। অন্যদিকে একই বিষয়ে মােস্তফা কামাল লেখেন, ‘ঈদগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২৪ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ে ধর্মঘট করে।’ (আবু মােহাম্মদ দেলােয়ার হােসেন)।
কিন্তু প্রশ্ন থাকে, কক্সবাজার সদরের হাইস্কুলের ছাত্ররা যদি ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে থাকে মিছিল, স্লোগান, সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, সে ক্ষেত্রে ঈদগাঁও হাইস্কুলের ছাত্রদের সে খবর না জানা অস্বাভাবিকই বটে।
যা-ই হােক পূর্বোক্ত মুহম্মদ নুরুল ইসলামের লেখায় বলা হয়েছে যে ঢাকার ঘটনাবলির প্রতিবাদে ২৫ ফেব্রুয়ারি ঈদগাঁও হাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট, মিছিল ও সভায় সমবেত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র নূরুল আজিম চৌধুরী।
তবে রামু থানার ‘খিজিরে হাইস্কুল’-এর ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্লাস বর্জন, ধর্মঘট ও মিছিল, স্লোগানসহ আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। এ ছাড়া মিঠাছড়ি এবং চকরিয়া হাইস্কুলের ছাত্ররাও অনুরূপ তৎপরতার প্রকাশ ঘটায়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে কুতুবদিয়া থেকে দুর্গম টেকনাফ পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে রামু এবং চকরিয়ার ছাত্রদের ছিল বিশেষ ভূমিকা।
কক্সবাজারে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় ১৯৬২ সালে। অবশেষে ১৯৭৭ সালে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক