ভাষা আন্দোলনে টেকনাফ
দুর্গম এলাকায় একুশের উত্তাপ
সমগ্র পূর্ব বাংলায় একুশের ভাষা আন্দোলন এতটা ব্যাপক হয়ে উঠেছিল যে দক্ষিণে দূর সাগরপারের টেকনাফ-কক্সবাজারেও আন্দোলনের ঢেউ লাগে। রাজনীতিমনস্ক ছাত্রদের চিন্তা ছুঁয়ে যেতে পারে একুশে-পরবর্তী কালের বহুখ্যাত রাজনৈতিক স্লোগান ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া…’। কক্সবাজার মহকুমার দূর প্রান্তিক থানা টেকনাফ একুশের উত্তাল ঢেউয়ে শরিক হয়েছিল। ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক-এর মাধ্যমে টেকনাফে পৌছায় ঘটনার চার দিন পর ভিন্নমতে টেকনাফে ঢাকার ঘটনাদির সংবাদ পৌছে দৈনিক আজাদ-এর মাধ্যমে (মুহম্মদ নূরুল ইসলাম)।
এ খবর জানিয়ে সংবাদ প্রতিবেদক আবদুল কুদ্দুস লিখেছেন যে দেরিতে হলেও এ সংবাদ টেকনাফে পৌছানাের পর টেকনাফ মাইনর স্কুলের শিক্ষক ও বালক ছাত্ররা আন্দোলনে নেমে পড়ে। সাগরের ঢেউয়ে ওঠা কলরবের মতােই শিশু ও বয়স্ক কষ্ঠের উচ্চারণ একাকার হয়ে ওঠে বিক্ষোভের উন্মাদনায় : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পূর্বোক্ত প্রতিবেদকের ভাষ্যমতে, ২৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু অবিনাশচন্দ্র, বাবু মংনি, সৈয়দুর রহমান পােস্টমাস্টার, মাস্টার আবদুর রবের উৎসাহ ও সহযােগিতায় ছাত্ররা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা, নিম্নমাধ্যমিক শিশুছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন! শুধু তা-ই নয়, এই বয়সে কোনাে ভয়ডর না করে তাদের ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়াও নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। একুশের ছিল এমনই এক জাদুকরি আকর্ষণ।
বায়ান্ন সালের ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি পূর্বোক্ত নিম্নমাধ্যমিক স্কুলের ছাত্ররা স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। মিছিলটি স্থানীয় বাজার ও স্টেশন রাস্তা অতিক্রম করলে সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ শিশুছাত্রদের উৎসাহ দিতে মিছিলে যােগ দেয়। স্লোগান ওঠে : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘খুনি নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি।
যেমন যােগ দিয়েছিলেন ‘নূর আহমদ, অলী আহমদ সওদাগর, আবদুর রহমান, আবদুল গণি, সালেহ মাস্টার, যদুনাথ, এম এ শুকুর, জালালউদ্দিন আহমদ, সুব্রত দে, জহির আহম্মদ, মােহাম্মদ মিয়া মেকার, হােছেন আহমদ, নুরুজ্জামান, নুরুল হক মাস্টার, আবদুল মুনাফ, আমীর হামজা, বদিউর রহমান প্রমুখ। সম্ভবত সর্বাধিক বিস্ময়কর ঘটনা হলাে টেকনাফের মতাে অনুন্নত দুর্গম অঞ্চলে (যেখানে তখন একটি হাইস্কুলও ছিল না) অল্পবয়সী ছাত্রীরাও আন্দোলনে যােগ দিতে মিছিলে শরিক হয়েছিল। অভাবিত এ ঘটনার কারণেই বােধ হয় সংবাদ প্রতিবেদনে সংবাদ—শিরােনাম ‘টেকনাফে মিছিল করেছিল ছাত্রীরা’।
তখনকার যাতায়াতব্যবস্থার বিবেচনায় টেকনাফ, উখিয়া দুর্গম এলাকা হিসেবেই গণ্য হতাে। যাতায়াতের একমাত্র ভরসা জলপথ ও জলযান। সাম্পান ছাড়াও যাতায়াত করত দুটো স্টিমার। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন রবি ও বৃহস্পতিবার টেকনাফ থেকে সাগরপথে মহকুমা শহর কক্সবাজার হয়ে জেলা শহর চট্টগ্রাম পর্যন্ত যাতায়াত করত। সরাসরি টেকনাফ-কক্সবাজার কোনাে সড়ক যােগাযােগ ছিল না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে যাতায়াত ও যােগাযােগের এমন এক দুরবস্থায় খবর আসা-যাওয়াও ছিল একই রকম। তা ছাড়া, চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রভাব ও স্পর্শ কক্সবাজারে পৌছালেও তা টেকনাফ বা উখিয়ার জন্য ছিল দুরস্ত। তাই সংবাদপত্রের দেখা পাওয়া যেত সপ্তাহখানেকের বাসি খবর নিয়ে।
স্বভাবতই সরকারি দল মুসলিম লীগই ছিল টেকনাফ, উখিয়ার মতাে এলাকায় একমাত্র রাজনৈতিক দল। তাদের শাসন-শােষণ দুই-ই চলেছে অব্যাহতভাবে। এমন এক একাধিপত্যের রাজত্বে একুশের প্রতিবাদী মিছিল ও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বলিষ্ঠ উচ্চারণ সবার জন্যই ছিল অবাক হওয়ার মতাে ঘটনা।
আন্দোলন নস্যাৎ করতে সরকারি দল মুসলিম লীগ উঠেপড়ে লাগে। তারা টেকনাফে চারটি জনসভা করে ঘােষণা দেয় যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। উর্দুর বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করবে, তারা পাকিস্তানের দুশমন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিবেদকের বিবরণমতে, ভাষাবিরােধী পূর্বোক্ত সভাগুলােতে যােগদানকারী নেতা ও ঘােষকদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য প্রধান ব্যক্তি ফজলুল কাদের চৌধুরী (ফকা চৌধুরী), চকরিয়ার মকসুদ আহমদ চৌধুরী, আনােয়ারার নুরুল আনােয়ার, উখিয়ার মীর কাশেম চৌধুরী, রামুর জাফর আলম চৌধুরী, আবদুল গফুর চৌধুরী প্রমুখ রাজনৈতিক বাঘ-সিংহ। বলতে হয়, রীতিমতাে রাজসিক আয়ােজন ছােট্ট টেকনাফের ততােধিক ছােট ছাত্রদের ভাষিক প্রতিবাদ দমন করতে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে টেকনাফের অবস্থানগত ও রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির বিবেচনায় শিশুছাত্রদের এ আন্দোলন ছিল অভূতপূর্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। তবে তুলনামূলক বিচারে উন্নত অবস্থানের রামু ও কক্সবাজারের ভাষা আন্দোলন ছিল অনেকটা ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু টেকনাফের শিশুছাত্ররাও অভাবিত এক তৎপরতায় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তাদের যে ভূমিকা নিশ্চিত করে গেছে, তা তাদের বয়স ও সেখানকার সামাজিক-রাজনৈতিক বিচারে তুলনার অতীত।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক