ভাষা আন্দোলনে গাইবান্ধা
মূলনীতি কমিটির সিদ্ধান্ত আন্দোলনে প্রেরণা জোগায়
ভাষা আন্দোলনের আগুন দ্রুতবেগে ঢাকা থেকে জেলা শহর হয়ে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বত্রই এর মশালবাহক ছিল ছাত্রসমাজ। ছাত্রদের সঙ্গে সহমর্মিতায় পথে নেমে আসে এলাকার সাধারণ মানুষ- পেশাজীবী থেকে শ্রমজীবী মানুষ, কোথাও কৃষক, কোথাও শ্রমিক। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি তথা একুশে ফেব্রুয়ারি সূচিত আন্দোলনের এমনটাই ছিল চরিত্র। উদাহরণ রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমা। এবং এর ফুলছড়ির মতাে একাধিক থানা। গােটা প্রদেশের জেলা শহর, মহকুমা শহর, নিস্তরঙ্গ থানা শহর থেকে ইউনিয়ন হয়ে গ্রামের স্কুল পর্যন্ত আন্দোলনের স্পর্শে উত্তেজক চরিত্র অর্জন করে, কম আর বেশি। গাইবান্ধায় মুসলিম লীগের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন ততটা দানা বাঁধেনি।
কিন্তু একুশে শুধু সেই শহরেই নয়, গােটা অঞ্চলকেই স্পর্শ করে। এখনাে ভাবি, কী জাদুতে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে ভাষার দাবি নিয়ে এমন সচেতনতা তৈরি হয়েছিল ছাত্রসমাজে, যার প্রভাব সঞ্চারিত হয় জনমনে। নিয়মমাফিক ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক শহর গাইবান্ধাকে ততটা স্পর্শ না করলেও সে প্রভাবে পরের বছর (১৯৪৯) রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদী সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ এ বিক্ষোভে শামিল হন সম্ভবত ভাষিক আবেগের তাগিদে।
১৯৫০ সালে সরকার প্রণীত মূলনীতি কমিটির সিদ্ধান্তের কল্যাণে ঢাকা শহরের মতাে প্রদেশের বিভিন্ন শহরে সীমাবদ্ধ পরিসরে ভাষিক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। গাইবান্ধাও ব্যতিক্রম ছিল না। এখানে ১৯৫০ সালে গাইবান্ধা হাইস্কুল ও একাধিক শিক্ষায়তনের ছাত্রদের মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিবাদী বিক্ষোভ দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। এ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের সমর্থন ততটা না হলে ও বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও শ্রমজীবী মানুষের সংশ্লিষ্টতা ছিল লক্ষ করার মতাে। যেমন কৃষক সমিতি, বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন ইত্যাদি। বাদ যায় না কমিউনিস্ট পার্টিও।
কিন্তু ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যেমন ঢাকায়, তেমনি দেশের অন্যত্র এর চরিত্রই আলাদা। ছাত্রদের প্রতিবাদী আন্দোলনে দেখা গেল রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ, সঙ্গে শ্রেণি-রাজনীতির কিছুটা প্রভাব। তা ছাড়া ১৯৪৮ পেরিয়ে ১৯৫২ সালে পৌছে একাধিক ছাত্রসংগঠন ও শ্রেণিসংগঠনের প্রভাবে একুশে সংহত রূপ ধারণ করে। প্রমাণ ‘৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাইবান্ধায় গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। আহ্বায়ক মতিউর রহমান, সম্পাদক হাসান ইমাম টুলু। (মাহবুবুল শাহীন, ভােরের কাগজ)।
কমিটিতে আরও ছিলেন আজিজুর রহমান, কাজী আবদুল হালিম, খান আলী তৈয়ব, শাহ ফজলুর রহমান, কার্জন আলী প্রমুখ। একুশে পরবর্তীকালে গঠিত ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন আলী তৈয়ব এবং সম্পাদক কার্জন আলী। বছর কয়েক আগে গুরুতর অসুস্থ ভাষাসংগ্রামী কার্জন আলীর পরিবারের সঙ্গে যােগাযােগ ঘটে বিশেষ কারণে। সে অসুস্থতা থেকেই কিছু সময় পর তার মৃত্যু হয়। ভাষাসংগ্রামী কার্জন আলী পরবর্তীকালে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সংগ্রাম কমিটির অন্যরা ন্যাপসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় গাইবান্ধায়ও অন্যান্য শহরের মতােই ভাষা আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত সূচনা। ২২ ফেব্রুয়ারি পূর্বোক্ত সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে গাইবান্ধা শহরে বিশাল জনসভা হয়। এ উপলক্ষে মিছিল, স্লোগান এবং স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। পুলিশের লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে চলে মিছিলের শহর পরিক্রমা।
হরতাল উপলক্ষে শিক্ষায়তন ও দোকানপাট বন্ধ থাকে। যেমনটা দেখা গেছে রাজধানী ঢাকায়। পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ ছাড়াও আন্দোলন বন্ধ করতে আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি ও মামলা করে। তা ছাড়া মুসলিম লীগ দলের ঐতিহ্যমাফিক তাদের মাস্তান বাহিনীর হামলাও চলে। আন্দোলনে বিশেষভাবে দেখা গেছে ঢাকার তুলনায় শহরগুলােতে পুলিশের অধিকতর উপদ্রব।
এ আন্দোলন যেমন শহর গাইবান্ধায় সীমাবদ্ধ না থেকে শহরের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি পরবর্তী কয়েক দিন অব্যাহত তালে প্রতিবাদ মিছিলও চলে। পুলিশের জুলুমবাজিতে নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পর অন্যদের আত্মগােপনে থাকতে হয়। এ আন্দোলনের উত্তরপ্রভাবে ১৯৫৩ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনে জোয়ারি আবেগ সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব পড়ে জনমানসে। স্বভাবতই পুলিশ ও সরকারি গুন্ডা হামলার প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-জনতার পাল্টা হামলা চলে মুসলিম লীগ অফিসে। এ ছাড়া আন্দোলনের ইতিবাচক উত্তরপ্রভাব পড়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে, যুক্তফ্রন্টের পক্ষে তৈরি হয় ব্যাপক জনসমর্থন এবং পরিণামে তাদের বিজয়। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য আহমদ হােসেন, আজিজুল হক, দৌলতুন নেছা প্রমুখ।
গাইবান্ধায় শহীদ মিনার তৈরির প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৫৫ সালে। সে উদ্যোগ ১৯৫৬ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সীমাবদ্ধ থাকে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রজনতার চেষ্টায় ১৯৫৭ সালে নির্মিত হয় পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার। একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার পর আবার স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে শহীদ মিনার নির্মিত হয়।
গাইবান্ধায় একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) দিনটি থেকেই যে ভাষা আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করেছিল, তার প্রমাণ মেলে আজাদ পত্রিকার ২২ ফেব্রুয়ারি ঘটনাস্থল থেকে পাঠানাে প্রতিবেদনে:
‘গতকল্য এইখানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সকাল হইতে শহরের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে। স্থানীয় কলেজ, স্কুল ও বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীগণ ধর্মঘট পালন করে এবং বেলা ১১টার সময় ১৫ শত ছাত্রের এক শােভাযাত্রা বিভিন্ন ধ্বনি সহকারে শহর প্রদক্ষিণ করে। বৈকাল ৫ ঘটিকায় স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল ময়দানে এক জনসভা হয়। জনাব খন্দকার আজিজুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করা হয়।’
এ ছাড়া ভাষা ও প্রদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট একাধিক দাবি বক্তাদের কথায় এবং গৃহীত প্রস্তাবে প্রকাশ পায়। ২২ ফেব্রুয়ারি এবং পরবর্তী কয়েক দিন আন্দোলন আরও তীব্র রূপ ধারণ করে। এর কারণ ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকটি অমূল্য জীবন নষ্ট হওয়ার প্রতিক্রিয়া। ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদদাতার পাঠানাে এমন এক রিপাের্ট ২৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত হয়। সংবাদদাতার বিবরণ মতে : ‘গাইবান্ধা গােরস্তান মাঠে ছাত্রদের একটি এবং মিউনিসিপ্যাল পার্কে জনসাধারণের আর একটি মােট দুইটি বিরাট সভা হয়।’
সভা দুটোতে যথারীতি পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং এ জন্য সরকারের তীব্র সমালােচনা, নিরপেক্ষ তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি দাবি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই সঙ্গে নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেও প্রস্তাব নেওয়া হয়।
গাইবান্ধার ভাষা আন্দোলন শুধু শহরের ছাত্র-জনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রদেশের অন্যান্য জেলা ও মহকুমার মতােই এখানকার থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক