You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে নওগাঁ - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে নওগাঁ
নওগাঁর উল্লেখযােগ্য ভূমিকা

নওগাঁ রাজশাহী জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মহকমা। ইংরেজ আমলে এ অঞ্চল গাঁজা চাষের সুবাদে খ্যাতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। শিক্ষাক্ষেত্রেও অগ্রসর ছিল নওগাঁ। রাজশাহীর সঙ্গে নওগাঁর বিশেষ যােগাযােগের মূল কারণ নওগাঁবাসী রাজনীতিমনস্ক প্রগতি চিন্তার ছাত্রদের রাজশাহী কলেজে পাঠ গ্রহণ ও ছাত্ররাজনীতিতে অংশগ্রহণ- যেমন স্বনামখ্যাত ছাত্রনেতা আবুল কাশেম চৌধুরী।
স্বভাবতই ১৯৪৮-এর মার্চের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নওগাঁকেও স্পর্শ করে। আরও একটি কারণ গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা-প্রচেষ্টার অন্যতম সহযােগী রাজশাহীর আতাউর রহমান। তিনি এ সময় ভাষা আন্দোলন সুসংগঠিত করার কাজে নওগাঁ, বগুড়া এসব অঞ্চলে সাংগঠনিক তৎপরতায় লিপ্ত থাকায় ভাষাচেতনার বিকাশ অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছিল।
এ সময় পর্বের আন্দোলন সম্পর্কে খােন্দকার মকবুল হােসেন লিখেছেন, ‘২৭ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে নওগাঁয় সিরাজ উদ্দীনের সভাপতিত্বে সভা হয়। সভায় নবী উদ্দিন, আমিন উদ্দিন, ইব্রাহিম চৌধুরী, আতাউর রহমান (রাজশাহীর) বক্তৃতা করেন।… নওগাঁ মহকুমাব্যাপী আন্দোলনের জন্য সর্বদলীয় কমিটি গঠিত হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী প্রদেশের একাধিক শহরের মতাে নওগাঁয় ছাত্রধর্মঘট পালিত হয়। পূর্বসূত্রমতে, এ আন্দোলন আত্রাই, রানীনগর, নাজীপুর, মহাদেবপুর, বদলগাছি, নিয়ামতপুর প্রভৃতি দূর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আন্দোলন প্রকাশ পেয়েছে স্কুলছাত্রদের ক্লাস বর্জন, ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভার মাধ্যমে।
১৯৫২- এর ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন অবশ্য পূর্বোক্ত আন্দোলনের তুলনায় অনেক ব্যাপক আকার ধারণ করে গােটা প্রদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। নওগাঁতেও একই ঘটনা। মাে. খােসবর আলী এ প্রসঙ্গে (নওগাঁ জেলার ভাষা আন্দোলন) লিখেছেন, ‘১৯৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নওগাঁ শহরের ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের সমন্বয়ে মাদ্রাসা মাঠে একটি সভা হয়। এ সভায় নওগাঁর সন্তান বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রাক্তন ছাত্রনেতা জনাব আবুল খায়ের সভাপতিত্ব করেন। বক্তৃতা করেন আনসার আলী, মােজাহারুল হক (পােনা), এম এ রকীব প্রমুখ। এ ছাড়া আনসার আলী নওগাঁ, নাটোর প্রভৃতি স্থানে কর্মী সম্মেলনও করেন।’
পূর্বপ্রস্তুতির কারণে নওগাঁয় ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি যথাযথভাবেই পালিত হয়। যথারীতি ছাত্রধর্মঘট, হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে। পূর্বসূত্রমতে, মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন মােজাম্মেল হক, মােজাহারুল হক (পােনা), খালেদ তাহের (মুকু), শেখ নুরুল ইসলামসহ অনেকে। ওই দিন ধর্মঘটের সমর্থনে নওগাঁর প্রায় দোকানপাট বন্ধ ছিল।’ (মাে. খােসবর আলী)।
একুশের আন্দোলন অন্যান্য মহকুমা শহরের মতাে নওগাঁ মহকুমারও দূর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন এর লেখক অধ্যাপক তসিকুল ইসলামসহ একাধিক লেখক অজপাড়াগা নাজীপুরের স্কুলছাত্রদের ‘হরতাল ও প্রতিবাদ সভা’র কথা উল্লেখ করেছেন। বিস্ময়কর যে এই দূরপ্রান্তের খবরটি ছাপা হয় দৈনিক আজাদ-এ (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)। সংবাদটি নিম্নরূপ :
‘নাজীপুর (রাজশাহী), ২১শে ফেব্রুয়ারী- অদ্য নাজীপুর হাইস্কুলের ছাত্ররা হরতাল পালন করে এবং “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ধ্বনিসহ এক বিরাট শােভাযাত্রা বাহির করিয়া সমগ্র গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। অতঃপর স্থানীয় ডাকবাংলাে প্রাঙ্গণে এক সভায় সমবেত হয়। সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার সম্মানদানের জন্য রাষ্ট্রনায়কগণের নিকট দাবী জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।
অন্য একটি সূত্রে প্রকাশ, ‘এলাকার অজপাড়াগা নিয়ামতপুর থানা সদরে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করেছিলেন। …মিছিলে নেতৃত্ব দেন কায়েম, ফসিউদ্দিন, ফয়েজ উদ্দীন, আজগর আলীসহ আরও অনেকে।’ একই সূত্রে প্রকাশ, ‘২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট, মিছিল ও প্রতিবাদ সভায় নওগাঁ অঞ্চলের প্রতিটি থানা ও মফস্বল ছাত্রছাত্রী এবং জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।’ (মাে. খােসবর আলী)।
নওগাঁর আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি আন্দোলন চলেছে পরবর্তী দিনগুলােতে ধর্মঘট, মিছিল এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে। একই ঘটনা ঘটে মহকুমার প্রান্তিক এলাকায়। এ সম্বন্ধে দু-একটি উদাহরণ ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক