ভাষা আন্দোলনে নীলফামারী
প্রতিক্রিয়াশীল দমননীতিতেও উত্তাল
নীলফামারী রংপুর জেলার একটি মহকুমা। বর্তমানে জেলা। দেশ বিভাগ-পূর্ব সময়ে এখানে একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির। পশ্চাৎপদ ছিল মুসলমান সমাজ। রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান দল ছিল কংগ্রেস, ফরােয়ার্ড ব্লক, কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লীগ। দেশবিভাগের সহিংসতার কারণে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এই মহকুমা শহর থেকে উল্লিখিত রাজনৈতিক দলের হিন্দু নেতা-কর্মীদের প্রায় সবাই দেশত্যাগ করে, সামান্য কিছুসংখ্যক কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী বাদে। স্বভাবতই প্রাধান্য তৈরি হয় মুসলিম লীগ রাজনীতির। তদুপরি বাস্তুত্যাগীদের শূন্যস্থান পূরণ করতে ভারত থেকে যেসব মুসলমান পরিবার নীলফামারীতে আসে, তাদের প্রায় সবাই মুসলিম লীগপন্থী। তাই এখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বা প্রগতিবাদী রাজনীতিতে দেখা দেয় ব্যাপক দুর্বলতা। – স্বভাবতই ১৯৪৮ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলন নীলফামারীকে বড় একটা স্পর্শ করেনি। মুসলিম লীগ ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা নিয়ে শক্তিমান রাজনৈতিক দল হিসেবে সক্রিয় ছিল। অবশ্য এর মধ্যে জনাকয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী নীলফামারীতে আসেন। যেমন সিনিয়র মেডিকেল ছাত্র আমজাদ হােসেন, বদিউল আলম, আতােয়ার রহমান প্রমুখ।
১৯৫০-৫১ সাল নাগাদ নীলফামারীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ভিত গড়ে ওঠে। যথাক্রমে খয়রাত হােসেন, দবির উদ্দিন আহমদ, শওকত আলী প্রমুখ এবং সফিয়ার রহমানসহ একাধিক ছাত্রনেতার বিরামহীন কর্মতৎপরতায়।
পরবর্তীকালের সাংবাদিক মােস্তফা আবিদের বিবরণমতে পূর্বোক্ত রাজনীতিকদের প্রভাবে এবং ছাত্রনেতৃত্বের শ্রমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের একটি শক্তিশালী মহকুমা শাখা গঠিত হয়েছিল। এর পর সম্পাদক সফিয়ার রহমান ও সভাপতি আবু তাহের। উল্লেখযােগ্য কর্মীদের মধ্যে ছিলেন আক্কাছ আলী, মােফাজ্জল হােসেন, তােফাজ্জল হােসেন আলিয়ার রহমান, খােরশেদ আলম, কাদেমুল হক, মজিবর রহমান প্রমুখ।
লক্ষ করার বিষয় যে শিক্ষায়তনগত দিক থেকে নীলফামারীতে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া মাত্র দুটো উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় (হাইস্কুল) ছিল। একটি বালকদের, অন্যটি বালিকাদের জন্য। তা সত্ত্বেও এ দুটো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগেই নীলফামারীতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলত, সংঘটিত হতে পেরেছিল।
আন্দোলনের কর্মতৎপরতা শুরু হয় ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিক থেকেই। শুরু হয় ছাত্রধর্মঘট এবং মিছিল ও স্লোগান। ফলে আন্দোলনের যে আবহ তৈরি হয়, সেই টানে স্থানীয় সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষা ও আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে থাকেন। এর পেছনে থাকে সরকারবিরােধী রাজনৈতিক দলের সমর্থন। সেই সঙ্গে সমর্থন শহরের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিবাদী চেতনায় শিক্ষিত শ্রেণির সদস্যদের। এভাবে তৈরি হয়ে যায় একুশের প্রতিবাদী আবহ।
এমনকি ইতিবাচক পরিবেশে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহরের সব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটি ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে মিছিল, স্লোগানসহ প্রতিবাদ সভা হয়। সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগের কিছুসংখ্যক নেতা-কর্মী ওই প্রতিবাদ মিছিলে যােগ দেন।
ইতিমধ্যে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারির মিছিল ছাত্রজনতার মিছিলে পরিণত হয়। ঘটনা চরিত্র বিচারে শহর ঢাকার মতােই ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। দিনভর শহরে মিছিলের পথপরিক্রমা। বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে বিশাল ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিবাদ সভা।
বিচলিত স্থানীয় প্রশাসন। তাই আন্দোলন দমন করতে গ্রেপ্তার করা হয়। দবির উদ্দিন আহমেদ ও আবু নাজেম মােহাম্মদ আলীকে (২৫ ফেব্রুয়ারি)। প্রতিক্রিয়ায় পরদিন আন্দোলন আরও জোরদার হয়। জনসাধারণ আরও ব্যাপক সংখ্যায় প্রতিবাদ মিছিল ও সভায় যােগ দেয়। বিশাল এক মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু পুলিশ কৌশলে এ পর্যায়ে আন্দোলনের মূল নেতা সফিয়ার রহমান ও শামসুল হককে আটক করে জেলা সদর কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
পৃষ্ঠাঃ ৪৮
নীলফামারী মহকুমা শহরের ভাষা আন্দোলনও যথারীতি মহকুমার অধীন থানা এবং কোনাে কোনাে ইউনিয়ন স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এতৎসত্ত্বেও নীলফামারীতে শহীদ মিনার প্রথম তৈরি হয় ছােটখাটো আকারে ১৯৫৩ সালে, ছাত্রদের উদ্যোগে ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে। পরে ১৯৭২ সালে সর্বদলীয় উদ্যোগে পৌর পার্কে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।
নীলফামারীর ভাষা আন্দোলনে স্থানীয় তৎপরতায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দবিরউদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শওকত আলী ও আবু নাজেম মােহাম্মদ আলী (স্বনামখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের পিতা) এবং ছাত্র সফিয়ার রহমান ও তাঁর নিকট ছাত্রবন্ধুরা। শেষােক্তদের ভূমিকা প্রকাশ্যে। অন্যরা নেপথ্যে, পরে প্রকাশ্য মিছিলে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক