ভাষা আন্দোলনে সুনামগঞ্জ
একুশের ডাকে জাগে দূর প্রান্তিক শহর
সিলেট জেলার মহকুমা শহর সুনামগঞ্জ, ভাটি এলাকা নামে খ্যাত। দূরপ্রান্তিক অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও সুনামগঞ্জ রাজনৈতিক বিচারে অগ্রসর চেতনার এবং তা মূলত প্রগতিশীল ধারার। হাজেরা খাতুন লিখেছেন, ‘ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতাসংগ্রামে এই জেলার (তখনকার মহকুমার) সংগ্রামী জনতা যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা আজও প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। মূলত সুনামগঞ্জের সন্তান হিসেবে ভাষা আন্দোলনের পরিচিত ব্যক্তিত্ব নওবেলাল সম্পাদক মাহমুদ আলী, আখলাকুর রহমান, আবদুস সামাদ প্রমুখ।
সম্ভবত প্রান্তিক অঞ্চল হওয়ার কারণে ১৯৪৮-এর আন্দোলন সুনামগঞ্জের ছাত্রসমাজকে ততটা সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। তা ছাড়া আরও একটি বিষয় বিবেচ্য। মুসলিম লীগ রাজনীতির সম্প্রদায়বাদী চরিত্র পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ স্থানে রাজনৈতিক চেতনার চরিত্র বদল ঘটিয়েছিল, বিশেষ করে যেসব স্থানে প্রগতিবাদী কৃষক, শ্রমিক বা অনুরূপ রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব ছিল না। সুনামগঞ্জের পরিস্থিতিও এদিক থেকে ভিন্ন ছিল না।
তা সত্ত্বেও ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলনের সুবাতাস কিছুটা স্পর্শ করে অন্তত ভাষাচেতনার দিক থেকে। পূর্বোক্ত সুত্রমতে হােসেন বখত, আলতাফ উদ্দিন, আবদুল হাই, সত্যব্রত দাস, মঞ্জু দাস, আবদুল মতিন প্রমুখ রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন ছাত্রশিক্ষক সমাজে। ১৯৪৮ পেরিয়ে ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার যৌক্তিকতা বিষয়ে আলােচনা করার জন্য একটি সভা আহ্বান করা হয় সুনামগঞ্জ কলেজ প্রাঙ্গণে। উদ্যোক্তা কলেজছাত্র আবদুল মতিনসহ পূর্বোক্ত ভাষাসচেতন ব্যক্তিরা। কিন্তু বহু উদাহরণের মতাে এ ক্ষেত্রেও যথারীতি পুলিশের হামলা, লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার ইত্যাদি। এভাবেই সুনামগঞ্জে ১৯৪৮ পর্বের সমাপ্তি।
১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। ইতিমধ্যে ১৯৪৮ পর্বের তৎপরতা এবং পরবর্তী খণ্ড খণ্ড আন্দোলন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার যৌক্তিকতা নিয়ে বিশিষ্টজনদের লেখালেখি অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। এ পর্যায়ে নওবেলাল পত্রিকার সংবাদ পর্যালােচনা এবং সম্পাদকীয় প্রতিবেদনাদির তির্যক চরিত্র অনেকের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে সাহায্য করে। জন্ম নেয় ভাষাবিষয়ক লড়াকু চেতনা।
ঢাকায় ছাত্র হত্যার ঘটনা এই চেতনায় জ্বালানি যােগ করে। তাতে নতুন মাত্রা যােগ করে ঘটনার প্রতিবাদে এ অঞ্চলের বিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতা, পূর্বোক্ত নওবেলাল সম্পাদক মাহমুদ আলীর ভূমিকা। তার দৃষ্টান্ত অনুকরণ করেন মতছির আলী, এ জেড আবদুল্লাহ, আবদুর রহিম প্রমুখ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা।
২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) সুনামগঞ্জে আন্দোলন শুরু হয় ছাত্রধর্মঘট ও ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে। ছাত্র হত্যার সংবাদ ছাত্র-জনতার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। শহরবাসী মানুষ বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতে থাকে। শহরের স্কুল-কলেজের মতাে শিক্ষায়তনগুলােতে আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। শহুরে জনসমর্থন ছাত্রদের উৎসাহিত করে, সাহস জোগায়।
কোণঠাসা হয়ে পড়েন মুসলিম লীগদলীয় অবশিষ্ট রাজনৈতিক নেতারা। বিচলিত প্রশাসন। মহকুমা প্রশাসক এ অবস্থায় সংগ্রামী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আশ্বাস দেন যে পুলিশ বিনা প্ররােচনায় কোনাে প্রকার হামলা চালাবে না।
একুশের ভাষা আন্দোলন সুনামগঞ্জ শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অন্যান্য মহকুমা শহরের মতাে এখানেও আন্দোলন থানা ও প্রান্তিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। যেমন জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর থানার একাধিক এলাকায়। উল্লেখ্য যে মাহমুদ আলীর স্ত্রী হাজেরা মাহমুদ ছিলেন আরও কিছুসংখ্যকের মতাে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তিনি এ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন।
সুনামগঞ্জ মহকুমার কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীরা সেখানকার ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে যােগ দিয়েছেন বা সহযােগিতা করেছেন। প্রান্তিক ভাটি অঞ্চল হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের আন্দোলন বিষয়ক ঘটনাবলি ঢাকার দৈনিকগুলােতে অতি সামান্যই প্রকাশিত হয়েছে। তাই এতৎসংক্রান্ত তথ্যের অভাব প্রকট।
তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা চলে যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সময় পর্বে সুনামগঞ্জের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন পূর্বোক্ত এবং অনুক্ত একাধিক ভাষাসংগ্রামী। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য আবদুল হক, আলতাফ উদ্দিন, আবদুল মতিন চৌধুরী, হােসেন বখত, মাহমুদ আলী, মছির আলী, হাজেরা মাহমুদ, কাজল দাস, মঞ্জু দাস, বরুণ রায়, মুসলিম চৌধুরী, মকবুল হােসেন, শাহেরা বানু প্রমুখ। এমনকি উল্লেখ করা যেতে পারে আখলাকুর রহমানের নামও, যাদের প্রেরণা ও সহায়তা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক