You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে নড়াইল
প্রথম শহীদ মিনার তৈরির কৃতিত্ব এদেরও

কে প্রথম, কে দ্বিতীয় বা তৃতীয় তা নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন। তবু বিতর্ক। রাজশাহীর ভাষাসংগ্রামীদের দাবি, যত ছােট বা অসম্পূর্ণ হােক, ২১ তারিখ রাতে (অবশ্য কারও মতে ২২ তারিখে) গড়া রাজশাহীর শহীদ মিনারই দেশের প্রথম শহীদ মিনার। অন্যদিকে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভাষাসংগ্রামীদের দাবি, তাদের শহীদ মিনার পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার, তাই গুরুত্বটা তাদেরই প্রাপ্য। আর এ শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয় এর কাছাকাছি জায়গায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
কিন্তু নড়াইলের শহীদ মিনার? যশাের জেলার প্রত্যন্ত মহকুমা হওয়া সত্ত্বেও অনেক বাধা-বিপত্তির মুখে চালিয়ে যাওয়া ভাষা আন্দোলনে একুশেতেই সংগ্রামী ছাত্ররা নড়াইলে গড়ে তােলেন একটি শহীদ মিনার।
প্রদ্যোত ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘তেভাগা আন্দোলনের ঐতিহ্যে লালিত নড়াইল আন্দোলনে সব সময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এখানে বামপন্থীরা সকল আন্দোলনে পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সূচিত আন্দোলনের দিনটিতেই “রাতারাতি মুসলিম বাের্ডিংয়ের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। রাতের আঁধারে সেখানে পুষ্পস্তবক দেওয়া হয়।” কিন্তু শহরের সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ‘নড়াইলের প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে।’
বিভাগ-পূর্ব নড়াইল ছিল রাজনীতিমনস্ক শহর, সেই সঙ্গে সাহিত্য- সংস্কৃতিচর্চায়ও অগ্রসর। শহরটিতে প্রধানত শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও পেশাজীবীদের বাস ছিল, যদিও বেশ কয়েকটি শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্ত পরিবারও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। যেমন জেলা বাের্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়ালিয়র রহমান, আফসার উদ্দিন মােক্তার, আবদুল মালেক, আবদুল জলিল, আবদুস সালাম মােক্তার প্রমুখ।
চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে স্থানীয় ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যয়নরত মুসলমান ছাত্রদের অধিকাংশই মুসলিম লীগপন্থী। তাঁদের মধ্যে বহিরাগত ছাত্রদের আবাসস্থল ছিল শহরের মধ্যখানে অবস্থিত বাের্ডিং হাউসে। সে সময় আবাসিক ছাত্ররা দেদারু পাতায় সজ্জিত একটি গেটও তৈরি রাখে ওই ছাত্রাবাসের সামনে (জিন্নাহ গেট)। এটা ছিল ১৯৪৬-৪৭-এ মুসলিম লীগ রাজনীতির প্রভাব। তবে নড়াইলে বিভাগ-পূর্ব সময়ে মূল রাজনীতির ধারা ছিল জাতীয় কংগ্রেস, কৃষক প্রজাপার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি ও তার অঙ্গসংগঠন প্রভাবিত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এসব তথ্যের উৎস।
১৯৪৭ সালের আগস্টে সূচিত দেশবিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার হুজুগে আতঙ্কিত মধ্যবিত্ত হিন্দুদের অধিকাংশই ভারতে পাড়ি জমায়। হয়তাে সে কারণেই ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন সেখানে ততটা জমে ওঠেনি। অথবা জমে উঠেছিল, কিন্তু তথ্য পরিবেশনের মতাে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেউ পূর্বোক্ত প্রতিবেদন তৈরির সময় ছিলেন না।
নড়াইলে সংগঠিত ভাষা আন্দোলন মূলত একুশেরই ইতিহাস বলা চলে। এখানেও প্রদেশের অন্যান্য প্রান্তিক শহরের মতাে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যতটা ঢাকা থেকে নির্ধারিত কর্মসূচির টানে, তার চেয়ে বেশি ঢাকায় সংঘটিত ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়ায়। পূর্বোক্ত প্রতিবেদন মতে, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ আফসারউদ্দিন মােক্তারকে সভাপতি মনােনীত করে ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তিপ্রতিম ব্যক্তিত্ব নূর জালালের কন্যা রিজিয়া বেগমসহ শহরের একাধিক রাজনীতিবিদ। এঁদের সঙ্গে আন্দোলনের প্রধান সংগঠক শক্তি হিসেবে উপস্থিত ছিল স্কুল ও কলেজের ছাত্রনেতৃত্ব। একুশের পরদিন থেকে আন্দোলনে গতি সঞ্চারিত হয় ঢাকায় ভাষাসংগ্রামীদের জমায়েতে গুলিবর্ষণের ফলে কয়েকজন ছাত্র -অছাত্র শহীদ হওয়ার মতাে ঘটনার কারণে।
রূপগঞ্জে অবস্থিত নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের সংগ্রামী ছাত্রদের উদ্যোগে সংগঠিত প্রতিবাদী মিছিল নড়াইল শহরে এসে পৌছালে স্থানীয় ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে শামিল হন। উদ্যোগী ছাত্রীদের মধ্যে উউল্লেখযোগ্য রিজিয়া, বেবি, রুবি, শেফালি, বুলবুল প্রমুখ। প্রশাসন ছিল আন্দোলনকারীদের চেয়ে এক পা এগিয়ে। অকারণে জারি করা হয় ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা।
তাই কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে আফসার মােক্তার সাহেব উপস্থিত ছাত্র-জনতার সামনে সংক্ষেপে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। এবং সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে গ্রহণীয় পদক্ষেপ সম্বন্ধে সিদ্বান্ত দিয়ে গ্রেপ্তার এড়াতে দ্রুত সভাস্থল ছেড়ে চলে যান। পুলিশ যথারীতি হামলা চালায় মিছিলে। নেতৃস্থানীয় অনেক ছাত্র আহত হন, মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়। যথারীতি বলা হয় শহীদ বেদিতে ফুল দেওয়া হিন্দুয়ানি। পুলিশ ইন্সপেক্টর গােলাম রাব্বানির নেতৃত্বে পুলিশি তৎপরতা চলে। (আশ্চর্য, এই পুলিশ সাহেবই একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হন।)
কিন্তু তাতে ছাত্রসমাজ উদ্যম হারায়নি। আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়েছে, তবে তা প্রধানত সভা, মিছিল, স্লোগান ও সমাবেশে প্রকাশ পেয়েছে। ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্ররা এ আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন। নেপথ্যে ছিলেন হাতে গােনা কয়েকজন রাজনীতিক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও সমাজের বিশিষ্টজন।
এই আন্দোলন শুধু নড়াইল বা রূপগঞ্জে সীমাবদ্ধ ছিল না; আন্দোলনের বিস্তার ঘটে শিক্ষায়তন ঘিরে আশপাশে ও দূর এলাকায়। যেমন : লােহাগড়া, লক্ষ্মীপাশা থেকে অভয়নগর, আলমডাঙ্গা, কালিয়া, গােবরা প্রভৃতি এলাকায়। আন্দোলনের পৃষ্ঠপােষকতায় ছিলেন স্থানীয় আইনজীবীদের অধিকাংশ এবং ফরিদুদ্দাহার, বটুকেশ্বর দত্ত, মােদাচ্ছের মুন্সী প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা।
শহরে তৈরি প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার পর রূপগঞ্জে ভিক্টোরিয়া কলেজের সংগ্রামী ছাত্রদের উদ্যোগে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলে সেটাও দুবৃত্তরা রাতের অন্ধকারে ভেঙে ফেলে। তাতে উদ্যম হারায়নি ছাত্রসমাজ। শহীদ মিনার বারবার তৈরি হয়েছে, শুধু নড়াইল শহরে বা রূপগঞ্জে ভিক্টোরিয়া কলেজেই নয়, মহকুমার একাধিক শিক্ষায়তন প্রাঙ্গণে গড়া হয়েছে শহীদ মিনার। সবশেষে স্বাধীনতা-উত্তরকালে নড়াইল শহরে হাইস্কুল এবং রূপগঞ্জে ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে শহীদবেদি, যেগুলাে শহীদ দিবস উদযাপনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!