ভাষা আন্দোলনে মুন্সিগঞ্জ
মিছিলে মিছিলে অচল ছােট্ট শহর
ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমা রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর অঞ্চল। বিক্রমপুর পরগনার শিক্ষা এবং সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনে বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে। মুন্সিগঞ্জের অদূরবর্তী বজ্রযােগিনী, সােনারং প্রভৃতি এসব দিক থেকে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম হিসেবে বিবেচিত। বিক্রমপুরের বেশ কিছু গ্রামাঞ্চল কৃষক আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত। মহকুমা শহর মুন্সিগঞ্জ সে ঐতিহ্যের বাইরে নয়, ভাষা আন্দোলনে স্বভাবতই শহর মুন্সিগঞ্জের ভূমিকা কোনাে অংশে কম নয়।
যােগাযােগব্যবস্থা ততটা উন্নত না হওয়া সত্ত্বেও আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের নিকটবর্তী হওয়ায় আন্দোলনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জানতে মুন্সিগঞ্জের আন্দোলনকারীদের খুব একটা অসুবিধা ছিল না। এদিক থেকে স্থানীয় হরগঙ্গা কলেজের ছাত্ররা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় বয়েজ স্কুল ও গার্লস স্কুলের (অ্যালবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্রমােহন গার্লস স্কুল) ছাত্রছাত্রীরাও আন্দোলনে অংশ নেয়।
মুন্সিগঞ্জে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকেই। হরতাল পালন করে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেই সঙ্গে তাদের মিছিল শহরের অলিগলি প্রদক্ষিণ করে। তাতে যােগ দেয় শহরবাসী বেশ কিছু মানুষ। বিকেলে ক্লাব মাঠে জনসভা। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আমির হােসেন। সভায় বক্তব্য দেন ছাত্রনেতাসহ হরগঙ্গা কলেজের অধ্যাপক সত্যরঞ্জন বসু, মােহিতলাল চট্টোপাধ্যায় ও মিনহাজউদ্দিন মৃধা।
আন্দোলনে নেতৃত্বদানসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কমিউনিস্ট কৃষকনেতা জিতেন ঘােষ, অজয় রায়, এম এ কাদের, সফিউদ্দিন আহমদ, ছাত্র-সাংবাদিক নিজামুদ্দিন আহমদ (একাত্তরে শহীদ), ছাত্রনেত্রী স্মৃতিকণা গুহ প্রমুখ। লেখকও এ আন্দোলনে যুক্ত।
ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়ে মুন্সিগঞ্জে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ নেতক ও তাদের পােষা ছাত্র-যুবা গুন্ডাদের যথেষ্ট দাপট ছিল। স্বভাবই পুলিশের সহযােগিতায় তারা সরকারবিরােধী আন্দোলনে, এমনকি ভাষা আন্দোলনেও হামলা চালাতে দ্বিধা করেনি। ব্যক্তিগত আক্রমণ ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন কেউ কেউ। যেমন বামপন্থী ছাত্রনেতা সফিউদ্দিন আহমেদ। এ নিবন্ধের লেখকও হরগঙ্গা কলেজের ছাত্র গুন্ডাদের হাতে প্রহৃত হয়ে কয়েক ঘন্টা থানায় আটক থেকে পরে মুক্তি পায়।
১৯৫২ সালের বিস্ফোরক একুশে ফেব্রুয়ারিতে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিমাফিক স্কুল-কলেজে ধর্মঘট, কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী ও জনতার মিছিল শহরের অলিগলি প্রদক্ষিণ করে, দুপুরে পার্কে ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকি লৌহজং ছাড়াও মালখানগর, বজ্রযােগিনী, সােনারং, গজারিয়ার মতাে গ্রামে এবং গুরুত্বপূর্ণ থানা ও ইউনিয়ন সদরে। গােটা মহকুমায় জাতীয় রাজনৈতিক পর্যায়ে নেতৃত্বে ছিলেন কোরবান আলী, জিতেন ঘােষ, এসহাক চাকলাদার, ভবেশ নন্দী প্রমুখ।
২৩ ফেব্রুয়ারি সাধারণ হরতাল পালনের আহ্বান জানানাে হয় জাতীয় রাজনীতিক ও ছাত্রনেতৃত্বের পক্ষ থেকে। হরতাল সফল হয় হরগঙ্গা কলেজ ও শহরের স্কুলগুলাের ছাত্রছাত্রীদের পিকেটিংয়ের সংগ্রামী বলিষ্ঠতায়। পুলিশের বেদম লাঠিপেটা সত্ত্বেও পিছু হটেনি ছাত্রছাত্রীরা। প্রণব সাহার প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুলিশ ১৭ জন ভাষাসংগ্রামীকে গ্রেপ্তার করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মহকুমার বিভিন্ন স্থানে একই চিত্র দেখা যায়।
২৬ ফেব্রুয়ারি পার্কে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার সমাবেশটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ সমাবেশ শুধু শহুরে ছাত্র-জনতার সমাবেশই ছিল না: পূর্বোক্ত প্রতিবেদকের ভাষ্যে এ সমাবেশে যােগ দেয় সােনারং থেকে টঙ্গিবাড়ী পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা। বিক্ষোভে, মিছিলে, হরতালে অচল হয় মহকুমা শহর মুন্সিগঞ্জ। দোকানপাট, যানবাহন, অফিসআদালত সব বন্ধ। সভায় বক্তারা আটক ছাত্রনেতাদের মুক্তি, স্থানীয় এমএলএ বিক্রমপুরীর পদত্যাগ, সর্বোপরি রাষ্ট্রভাষা বাংলার বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে এবং মন্ত্রিসভার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন। এ সভায় আনুমানিক হাজার দশেক মানুষ উপস্থিত ছিল। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এসহাক চাকলাদার। সংখ্যা ও চরিত্র বিচারে এটা স্মরণকালের অভূতপূর্ব ঘটনা।
মহকুমা জুড়ে ফেব্রুয়ারির দিনগুলােয় চলে সভা-সমাবেশ ও মিছিল। প্রতিবাদী স্লোগানে উচ্চকিত পরিবেশ। বৃহত্তর পরিবেশেও আন্দোলন সংঘটনের পেছনে মূল শক্তি ছাত্রসমাজ। মহকুমার স্কুলগুলাের সঙ্গে যোগাযােগের শ্রমসাধ্য কাজের দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতৃত্ব, নেপথ্যে স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতৃত্বেরও ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক