ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ
সংকটে ভরসা বৃন্দাবন কলেজ
দেশ বিভাজনকালে অনুষ্ঠিত গণভােটে আসাম প্রদেশের সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার রাজনীতিতে ছিল মুসলিম লীগের প্রাধান্য, যা দৌরাত্ম্যও বলা চলে। সিলেট শহর ভাষা আন্দোলনের সূচনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করলেও এর মহকুমাগুলােতে পরিস্থিতি এক রকম ছিল না।
শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমা ভাষা আন্দোলনের সূচনায় অগ্রসর ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ অনুপস্থিত বলা চলে। বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের অপপ্রচার হবিগঞ্জেও ছিল যথেষ্ট।
‘ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ’ বইটির লেখক তরফদার মুহাম্মদ ইসমাঈল জানাচ্ছেন, ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে পিছুটান সত্ত্বেও ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে বাহুবল থানা নিবাসী এম এল এ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ পাঠ্যক্রমে বাংলাকে অবহেলার কারণে শিক্ষামন্ত্রীর তীব্র সমালােচনা করেন।
মুসলিম লীগের অন্তর্ভুক্ত হবিগঞ্জের কয়েকজন প্রগতিমনা বুদ্ধিজীবী ‘হবিগঞ্জ মুসলিম সাহিত্য মজলিশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তােলেন। এই সংস্থার আমন্ত্রণে ১৯৫০-এর নভেম্বরে স্থানীয় টাউন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্যসভায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যােগ দেন। সে সভায় চুনারুঘাট, বানিয়াচং এলাকার বিশিষ্ট জনাকয়েক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষণে শুধু বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার অসুবিধার কথাই বলা হয়নি, বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষেও সমর্থন জানানাে হয়। স্থানীয় বৃন্দাবন কলেজ পরিদর্শনকালেও তিনি ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে আলােচনায় বাংলা ভাষার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন। সম্ভবত এ ঘটনার প্রভাব পড়েছিল হবিগঞ্জ মহকুমার বৃন্দাবন কলেজের ছাত্রদের ওপর।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সূচিত ভাষা আন্দোলনে দেখা যায় হবিগঞ্জের ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ন ভূমিকা। মূলত বৃন্দাবন কলেজের রাজনীতিসচেতন (বলা উচিত ভাষাসচেতন) ছাত্ররাই একুশের ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। এ সম্বন্ধে কিছু ভিন্নমত লক্ষ করা যায়। যেমন আমরা দেখেছি চট্টগ্রামের মতাে সহজ যাতায়াতের বন্দরনগরীতে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নমত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভুল তথ্য।
যেমন ২১ ফেব্রুয়ারিতে বৃন্দাবন কলেজে ছাত্রসমাবেশ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস-এ শেখ ফরহাদ এলাহী সেতু কলেজ। সংসদের ভিপির নাম লিখেছেন ‘সৈয়দ আফসার আহমদ’। অন্যদিকে পূর্বোক্ত বইয়ে তরফদার মুহাম্মদ ইসমাঈল লিখেছেন, বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র সংসদের সহসভাপতি সৈয়দ সফিক উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক জনাব আফছর আহমদ ইত্যাদি। পাঠক এ ক্ষেত্রে কোন তথ্যটি সঠিক হিসেবে গ্রহণ করবেন?
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে, বিশেষ করে আঞ্চলিক ইতিহাসে এ ধরনের পরস্পরবিরােধী মতামত লক্ষ করা যায়। ভাষা আন্দোলনের দুর্ভাগ্য যে রাজনৈতিক মহলে এর সর্বজনস্বীকৃত গুরুত্ব সত্ত্বেও শহরাঞ্চলের সঠিক ইতিহাস যথাসময়ে লিখিত হয়নি। ইতিমধ্যে অধিকাংশ ভাষাসংগ্রামী প্রয়াত। তাই পরবর্তীকালে লিখিত ঘটনার সত্যতা যাচাই করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতি সম্প্রতি বেশ কিছু জেলা, মহকুমা বা থানা শহরের আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার প্রবণতা দেখা দিয়েছে, লেখাও হচ্ছে, কিন্তু পূর্বোক্ত ধরনের সমস্যাও দেখা যাচ্ছে, যা সমাধান করা প্রায় অসম্ভব বলা চলে। উত্তরাঞ্চলের দু-একটি শহরের ভাষা আন্দোলন নিয়েও এমন ভিন্নমত দেখা গেছে একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। এ ক্ষেত্রে দৈনিক সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু সেখানেও দূরপ্রান্তিক শহরের আন্দোলন নিয়ে রয়েছে স্বল্পতা। তাই কিছু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
হবিগঞ্জে একুশের (১৯৫২) ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদন নিম্নরূপ, ‘২১শে ফেব্রুয়ারী।- অদ্য স্থানীয় ছাত্রদের দ্বারা গঠিত ভাষা কমিটির উদ্যোগে এখানে “বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা” দিবস প্রতিপালন করা হয়। স্থানীয় কলেজ ও স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এবং ব্যবসায়ীগণ পূর্ণ হরতাল পালন করে। প্রায় দেড় মাইল লম্বা এক শােভাযাত্রা “অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “মাতৃভাষাকে হত্যা করা চলবে না”, “জাতিকে হত্যা করা চলবে না” ইত্যাদি স্লোগান সহকারে শহরের সমস্ত রাস্তা পরিভ্রমণ করে। বেলা ১২.৩০ মিনিটের সময় শােভাযাত্রীগণ স্থানীয় স্টেশন মাঠে এক বিরাট জনসভায় মিলিত হয়। জনাব সৈয়দ রফিকুল হাসান বিএ সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করিয়া এক প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ (আজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
আজাদ পত্রিকায় উল্লিখিত ভাষা কমিটি সম্পর্কে জনাব ইসমাইল লিখেছেন, সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে কলেজ ও স্কুলের ছাত্রপ্রতিনিধিদের নিয়ে ২১ সদস্যের একটি ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। পরে এই কমিটির সদস্যসংখ্যা বাড়ানাে হয় বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে।
এ সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে মহকুমার একাধিক থানা ও অন্যান্য এলাকায় ভাষা আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। যেমন শায়েস্তাগঞ্জ, চুনারুঘাট, বাহুবল ইত্যাদি থানায়। দৈনিক আজাদ-এর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায় ২৪ ফেব্রুয়ারি শায়েস্তাগঞ্জে পূর্ণ হরতাল পালিত হয় এবং স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে প্রতিবাদ সভা হয়। সভায় স্কুলছাত্র আবদুল ওয়াদুদ, বিধান রায়, ফজলুল হক প্রমুখ বক্তৃতা করেন। এ সভায় জনসাধারণকেও উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।
হবিগঞ্জে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় ১৯৬৩ সালে স্থানীয় বৃন্দাবন কলেজের চত্বরে রাস্তাসংলগ্ন স্থানে। পরে ১৯৭৩ সালে হবিগঞ্জে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক