ভাষা আন্দোলনে ঝিনাইদহ
বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে আন্দোলনের সলতে জ্বালানাে
পূর্ববঙ্গে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের সময়, এককথায় ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সময় পরিসরে ঝিনাইদহ যশাের জেলার একটি মহকুমা শহর। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার কারণেই বােধ হয় এখানেও যথেষ্ট সংখ্যক অবাঙালি অর্থাৎ বিহারি মােহাজেরদের বসবাস, বিশেষ করে মহকুমা শহরে। তাদের অধিকাংশই অবস্থাপন্ন, নানা ধরনের ব্যবসায়ে জড়িত। রেল সংযােগ না থাকায় যােগাযােগব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম বাস সার্ভিস। এখনাে চলছে সেই একই পরিবহন ব্যবস্থা।
স্বভাবতই রাজধানী ঢাকার সঙ্গে ঝিনাইদহের যােগাযােগ মসৃণ ছিল না। তখন সংবাদপত্র বলতে আজাদ ও ইত্তেফাক। কাজেই রাজনৈতিক যােগাযােগ ও তথ্যাদির আদান-প্রদান ছিল সময়সাপেক্ষ ও ধীরগতির। শহরে স্থানীয় রাজনীতিতে ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রাধান্য। তা-ও ছিল মন্থর ধীরগতির। কংগ্রেসের কিছুসংখ্যক মুসলমান রাজনৈতিক নেতার ভূমিকা ছিল উদার গণতান্ত্রিক চরিত্রের। এঁদের সমর্থন ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতি।
এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য জেলা বাের্ডের ভাইস চেয়ারম্যান তােয়াজ উদ্দিন আহমদ (সাঈদ ডাক্তারের পিতা), নজর আলী, কেসমত আলী (ডা. সিরাজুল ইসলামের পিতা) প্রমুখ। এঁরা সবাই আইনজীবী এবং রাজনীতিসংশ্লিষ্ট। কিন্তু ছিল না কোনাে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন।
ছিল না কোনাে কলেজ। শিক্ষায়তন বলতে একটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় তথা হাইস্কুল। এবং একটি জুনিয়র বালিকা বিদ্যালয় (গার্লস স্কুল)। এসব কারণে ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন ঝিনাইদহে তেমন কোনাে প্রভাব ফেলেনি, বিশেষ করে প্রতিবাদী তৎপরতায়। তাই ঝিনাইদহে ভাষা আন্দোলন বলতে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি তথা একুশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
ইতিমধ্যে ১৯৪৯-এ ঢাকায় সরকারবিরােধী আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর এর রাজনৈতিক প্রভাব পড়ে প্রদেশের বিভিন্ন শহরে। বাদ যায়নি ঝিনাইদহ। স্বভাবতই উদারপন্থী গণতন্ত্রীরা এ সংগঠনে যােগ দেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হাবীবুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম, ডা. কে আহমদ, তরুণ ডা. সাঈদুর রহমান, ডা. খাদেমুল ইসলাম, ইকবাল আনােয়ারুল ইসলাম (আইনজীবী) প্রমুখ। বাম রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এঁদের মধ্যে কেউ কেউ, যেমন ডা. সাঈদর রহমান। ছাত্র সংগঠন বলতে মুসলিম লীগের সরকার-সমর্থক ছাত্র শাখা। ছাত্রলীগ তখনো সেখানে গড়ে ওঠেনি।
তাই ঝিনাইদহে বিস্ফোরক ভাষা আন্দোলন একুশের প্রকাশ বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্র-যুবাদের চেষ্টায়। তাদের পেছনে সমর্থন ছিল পূর্বোক্ত সরকার বিরোধী গণতন্ত্রী রাজনীতিমনস্ক বা রাজনীতিক ব্যক্তিদের। এ আন্দোলনের সূচনা মূলত ছাত্রদের তৎপরতায়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে প্রতিফলিত সেই তৎপরতা ও আন্দোলনের উৎস বা প্রেরণা ঢাকা বা জেলা সদর যশাের শহর থেকে আসা সংবাদ, পােস্টার ইশতেহার ইত্যাদি। যেমন ১৯ ফেব্রুয়ারি একুশের কর্মসূচি পালনে পােস্টার সাঁটা হয় ঝিনাইদহ শহরের দেয়ালে দেয়ালে।
তখন দূর শহর বা গ্রামাঞ্চলে কী দারুণ অসুবিধার মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে তৎপর হয়েছে তার অদ্ভুত সব প্রমাণ ধরা রয়েছে ইতিহাসে। ঝিনাইদহের তেমন একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন প্রতিবেদক বিমল সাহা। অনভিজ্ঞ ছাত্ররা ‘সাড়ে পাঁচ আনা দিয়ে এক শিশি আলতা কিনে কাঠির মাথায় তুলা পেঁচিয়ে তৈরি তুলির সাহায্যে পােস্টার লিখেছে।’ অন্য এক শহরের তথ্যে দেখা যায়, পােস্টার লেখার উপযােগী সাদা, মােটা কাগজ নেই বা তা কেনার মতাে অর্থ নেই, অগত্যা দোয়াতের কালাে কালি দিয়ে খবরের কাগজের ওপর মােটা হরফে পােস্টার লেখা হয়েছে। মাইক নেই তাে কী হয়েছে? টিনের চোঙা তাে আছে। কিংবা খবরের কাগজ মোটা করে পেচিয়ে চোঙার মতাে করে স্লোগান দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। পােস্টার সাঁটতে ব্যবহার করা হতো ময়দাগােলানাে আঠা।
বিচিত্র সব উপাদান, বিচিত্র সব পদ্ধতি সে সময় ভাষা আন্দোলন সফল করতে গ্রামাঞ্চলে বা ছােটখাটো শহরে ছাত্রছাত্রীরা ব্যবহার করেছে। কোনো কোনাে ক্ষেত্রে দেখা গেছে টিনের চোঙার অভাবে খালি কেরােসিন টিনের ক্যানেস্তারা পিটিয়ে চিৎকার করে স্লোগান দেওয়া হয়েছে, অনেকটা চৌকিদারের ঢ্যাঁড়া পেটানাের মতাে করে, যেমন করেছে শ্যামগ্রাম স্কুলের ছাত্ররা।
ঝিনাইদহে ঢাকায় ঘােষিত একুশের কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে নিস্তরঙ্গ পরিবেশে পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্রনেতাদের ব্যবস্থাপনায় ২০ ফেব্রুয়ারি রাতভর সিনেমা চালানাের এক ফাকে ছাত্রনেতারা হরতালের ঘােষণা দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা করে। এইভাবে শহরবাসীকে তারা হরতাল ও একুশের কর্মসূচি পালনে উদ্বুদ্ধ করে।
‘পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় শহরে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করা হলে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে।’ স্লোগানে মুখর ঝিনাইদহ শহর। রাস্তাগুলাে ভরে ওঠে মিছিলে মানুষের পদচারণে। সবার কণ্ঠে স্লোগান : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ছাত্রছাত্রীদের হরতালের আহ্বানে ভালাে সাড়া মেলে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। জোরজবরদস্তি করতে হয় না। ছাত্রদের পাশাপাশি মিছিলে অংশ নেয় জুনিয়র স্কুলের ছাত্রীরা। এদের প্রেরণার উৎস ওই স্কুলের শিক্ষিকা মনােয়ারা খাতুন (পরবর্তীকালের খ্যাতিমান সাংবাদিক মঞ্জুর আহমদের মা)। ঝিনাইদহে ভাষা আন্দোলন সংগঠনগত পরিচালনায় সংহত রূপে সংঘটিত হলেও এর গুরুত্ব কম ছিল না। গােটা শহর তাতে আন্দোলিত হয়েছিল শহরবাসীর পূর্ণ সমর্থন নিয়ে। প্রশাসনের বাধা ছিল। ছাত্রনেতাদের ঐক্য প্রয়াস এবং বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষার টানে আন্তরিক অংশগ্রহণ আন্দোলন সফল করে তােলে। একগুচ্ছ তরুণ ছাত্রনেতৃত্বের সাহসী ভূমিকা এ সফলতার মূল কারণ। এটাই ছিল বাস্তবতা।
তবে ভিন্ন প্রতিবেদনে (শেখ মােহা. শাখাওয়াত রেজা সেলিম) এমন বক্তব্য উঠে এসেছে যে আন্দোলন বাস্তবায়িত করতে ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্থানীয় সন্তান এনামুল হককে সভাপতি এবং ঝিনাইদহ হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আনােয়ার জাহিদকে সম্পাদক মনােনীত করে ১৫ সদস্যের ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সূচিত পরবর্তী কয়েক দিনের আন্দোলন প্রধানত মিছিলে ও স্লোগানে শেষ হয়েছে স্থানীয় প্রশাসক জনসভা অনুষ্ঠানের অনুমতি না দেওয়ার কারণে। কিন্তু মিছিলপ্রধান এ আন্দোলনে বিভিন্ন শিক্ষায়তনের ছাত্রছাত্রীরাই অংশগ্রহণ করেনি, সাধারণ মানুষ তাতে যােগ দিয়েছে এবং শহরের বিশিষ্টজন ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী, এমনকি ব্যবসায়ী অনেকে তাতে সক্রিয় সমর্থন জুগিয়েছেন, কেউ কেউ রাস্তায় নেমেছেন।
নেতৃস্থানীয় যে ছাত্রছাত্রীদের সাহসী তৎপরতায় একুশের ভাষা আন্দোলন ঝিনাইদহে সংঘটিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য এনামুল হক, জাহিদ হােসেন মুসা, মইনুদ্দিন, আনােয়ার জাহিদ, গােলজার রহমান প্রমুখ। সেই সঙ্গে মঞ্জুর আহমেদ, সুখদেব বিশ্বাস, নির্মল কুণ্ডু, বাসুদেব বিশ্বাস, আনােয়ারুল ইসলাম, সাবু, কালু, পবিত্র প্রমুখ।
ছাত্রীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে স্নিগ্ধা, আনােয়ারা, জাহানারা, হােসনেয়ারা, বেলা, হাসি, ছন্দা প্রমুখ। ঝিনাইদহের জন্য এটা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। অবশ্য এর কারণ আগেই বলা হয়েছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে গার্লস স্কুলের শিক্ষিকার প্রেরণায় ছাত্রীদের পক্ষে ব্যাপক মিছিলে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের অনেকে ছিলেন সহানুভূতিসম্পন্ন।
আন্দোলনের সূচনালগ্নের এবং পরেরও একটি ঘটনা উল্লেখযােগ্য। আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য বৈঠকের নিরাপদ কোনাে স্থান না থাকায় ছাত্রনেতারা কাঞ্জিলালের বিশাল আমবাগানে গােপন বৈঠকে মিলিত হতেন। শহর সম্প্রসারণের টানে এবং এর আবাসিক চাহিদা পূরণের কারণে। সেই ঐতিহাসিক আমবাগান এখন বিলুপ্ত।
২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশেষভাবে ২৪ ফেব্রুয়ারির ঝিনাইদহে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়মিত মিছিল ও মাঝেমধ্যে সভা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অব্যাহত থেকেছে। কারও কারও মতে এ আন্দোলনের রেশ মার্চের প্রথম দিক পর্যন্ত লক্ষ করা গেছে। ইতিমধ্যে আনােয়ার জাহিদ, বাসুদেব প্রমুখ স্থানীয় ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করার পর স্বাভাবিকভাবে আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
ঝিনাইদহে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাষাসংগ্রামীদের উদ্যোগে এবং স্থানীয় কিছুসংখ্যক গণ্যমান্য ব্যক্তির সার্বিক সমর্থনে (বিশেষ করে আর্থিক সহায়তায়)। শহীদ মিনারটি স্থাপিত হয় তৎকালীন হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। এখানেই ফুল দিয়ে শহীদ দিবস পালন করা হতাে।
স্কুল সম্প্রসারণের প্রয়ােজনে ১৯৬২-এর দিকে এই শহীদ মিনার ভেঙে কেসি কলেজের কাছাকাছি স্থানে নতুন শহীদ মিনার তৈরি করা হয়, যা আবার একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংস করে ফেলে। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে একাধিক স্থানে শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনিক উদ্যোগে শিশুপার্কের পাশে স্থায়ী শহীদ মিনারটি গড়ে তােলা হয়েছে।
শহর ঝিনাইদহ ও বৃহত্তর ঝিনাইদহের যেসব বিশিষ্টজন ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন শিক্ষাবিদ মুরারী মােহন ঘােষাল, প্রমথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনােয়ারা আহমেদ, হাবীবুর রহমান, সাবদার হােসেন, আমজাদ হােসেন, আসাদুজ্জামান খান, ডা. সাইদুর রহমান এবং শহরের বিশিষ্ট আইনজীবী ও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জনাকয়েক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
ঝিনাইদহের বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী জাহিদ হােসেন মুসার আন্দোলন বিষয়ক স্মৃতিচারণার দু-একটি মন্তব্যে ইতিহাসের ইতি। তাঁর মতে, এ আন্দোলনে ভাষা সংগ্রামীদের প্রভাবিত করেন স্থানীয় বামপন্থীরা। তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন আবদুল হক সাহেবের সহযােগী।… কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ উৎসাহ ছিল এসব কাজে।’ জাহিদ হােসেন মুসা ঝিনাইদহে কমিউনিস্ট পার্টির একজন বিশিষ্ট নেতা অধীর ধরের নাম উল্লেখ করেছেন। তা সত্ত্বেও ঝিনাইদহে ছাত্ররাজনীতি সংগঠিত পর্যায়ের ছিল না। আন্দোলনের চরিত্র তাই ছিল অনুরূপ চরিত্রের।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক