ভাষা আন্দোলনে চাঁদপুর
আন্দোলন বায়ান্নোর ফেব্রুয়ারিতে
ইংরেজ আমলের ত্রিপুরা জেলার পরিচয় পাকিস্তান আমলে বদলে গিয়ে হলো কুমিল্লা জেলা। আগে কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরা জেলার সদর মহকুমা। দেশভাগ, ভারতভাগের পর পূর্ব বাংলাসংলগ্ন পার্বত্য ত্রিপুরার নাম দাড়াল শুধুই ত্রিপুরা। হয়তাে তাই পূর্ববঙ্গের ত্রিপুরা জেলার নাম পাল্টে করা হলাে কুমিল্লা জেলা।
এ জেলারই প্রান্তিক মহকুমা, চাঁদপুর। মহকুমা শহরটি পদ্মা-মেঘনার মিলনস্রোতের তীরে অবস্থিত। জলপথে যােগাযােগের জন্য রয়েছে জাহাজঘাট। অন্যদিকে রয়েছে ট্রেনে যাতায়াতের ব্যবস্থায় প্রান্তিক রেলস্টেশন। স্টিমারযােগে চাঁদপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ কয়েক ঘণ্টার পাড়ি। তেমনি কয়েক ঘণ্টার যাত্রায় ট্রেনযােগে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা।
যাতায়াত ও যােগাযােগের এতটা সুবিধা সত্ত্বেও ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন চাঁদপুরের ছাত্র-জনতাকে ব্যাপকভাবে স্পর্শ করেনি। তবু ঢাকা থেকে ঘােষিত পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির কারণেই হয়তাে ১১ মার্চ (১৯৪৮) চাঁদপুর শহরে দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। বিকেলে ছাত্রদের একটি মিছিলকে শহর প্রদক্ষিণ করতে দেখা যায়। আর নদীর খাঁড়ির অপর পাড়ে অবস্থিত পুরান বাজারে একটি ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ব্যস, এতেই শেষ চাঁদপুরে ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন।
প্রকৃতপক্ষে চাঁদপুরে ভাষা আন্দোলনের যথাযথ প্রকাশ ১৯৫২-এর।ল ফেব্রুয়ারিতে মূলত স্কুল-কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে। আন্দোলন শুরু হয়। ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতদের সংবাদ চাঁদপুরে পৌছানাের পর ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে। একাধিক সূত্রে (যেমন ১৯৯৫ সালে ভােরের কাগজ-এর প্রতিনিধি) জানা যায়, ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংঘটিত গুরুতর ঘটনাবলির সংবাদ চাঁদপুরে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায় পাঠরত দুই চাঁদপুরবাসী- আবদুর রব ও বি এম কলিমউল্লাহ।
তাদের কাছ থেকে শােনা ঘটনার বিবরণ স্থানীয় ছাত্রদের উত্তেজিত করে তােলে। চাঁদপুর কলেজ এবং স্থানীয় স্কুলছাত্ররা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। কর্মসূচির মধ্যে ছিল কলেজ প্রাঙ্গণে কালাে পতাকা উত্তোলন, ছাত্রছাত্রীসহ সবার কালো ব্যাজ ধারণ এবং সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল।
একুশের ভাষা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যমাফিক এ আন্দোলনে সর্বশ্রেণির স্কুলছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেয়- প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। এরা শুধু ক্লাস বর্জন তথা ধর্মঘট করেই ক্ষান্ত হয়নি, মিছিলে যােগ দিয়েছে। কচি কচি কণ্ঠে স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশের জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি।
তল্কালীন চাঁদপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র এবং ১৯৯৫তে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক (চাঁদপুর প্রতিনিধি) শঙ্কর চন্দ্র জানান যে তারা তাদের প্রাথমিক স্কুল থেকে মিছিল করে রাস্তায় নেমে আসার পর আদালতপাড়ার কাছে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে। ভাবা যায় শিশুছাত্রদের মিছিলে লাঠিচার্জ!
তার বিবরণমতে, সেদিন চাঁদপুর কালাে পতাকা ও মিছিলের শহর। মিছিলে মিছিলে শুধু ছাত্ররাই নয়, সাধারণ মানুষও যােগ দেন, যেমন কর্মরত ডকশ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ। এককথায় ছাত্রমিছিল হয়ে ওঠে গণমিছিল। শহরের বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনও সেদিন মিছিলে যােগ দেন, এতটাই ছিল ছাত্র হত্যার কারণে সরকারবিরােধী প্রতিক্রিয়ার আবেগ।
ইতিপূর্বে কলেজে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় তৎকালীন ছাত্রনেতা মােল্লা সিদ্দিকুর রহমানকে আহ্বায়ক মনােনীত করে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটিতে ছিলেন শহরের বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। যেমন অ্যাডভােকেট মতিউর রহমান, শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকসহ আবদুস সামাদ, আবুল কালাম আজাদ, ফজলুল হক, আফজল হােসেন, ইয়াকুব আলী প্রমুখ।
পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি আরও জোরদার করা হয়। সেদিন মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র-জনতা এসে চাঁদপুর কলেজমাঠে জড়াে হয়। সেখান থেকে একটি বিশাল মিছিল বের হয় এবং নানাবিধ স্লোগানসহ গােটা শহর প্রদক্ষিণ করে। জনসাধারণ্যে সরকারবিরােধী চেতনা জন্ম নেয়।
মিছিল শেষে কলেজ প্রাঙ্গণে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পূর্বোক্ত মােল্লা সিদ্দিকুর রহমান। সভায় যথারীতি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসহ ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শােক দিবস ঘােষণা এবং নুরুল আমিনের পদত্যাগ ইত্যাদি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
আন্দোলন অব্যাহত থাকে মার্চের প্রথম দিক পর্যন্ত। ২৬ ফেব্রুয়ারি চাদপুর পুরান বাজারে ওসমানিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে এক বিরাট জনসভা হয়। এ সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলাসহ গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার দাবি করা হয় ( আজাদ, ৩ মার্চ ১৯৫২)। একই পত্রিকার বিবরণীতে ৫ মার্চ ১৯৫২ চাঁদপুর শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এদিন ছাত্র-জনতার একটি বিরাট মিছিল শহরের প্রধান রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে বিকেল তিনটায় স্থানীয় আজিজ আহমদ ময়দানে ছাত্র- জনসাধারণের মিলিত একটি বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা, নিরপেক্ষ তদন্ত, অপরাধীদের শাস্তি সহ বন্দি ছাত্রদের বিনা শর্তে মুক্তি দাবি করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় (আজাদ ১২ মার্চ, ২৯৫২)।
অন্যান্য মহকুমার মতো চাঁদপুর মহকুমার অধীন মতলবসহ বিভিন্ন এলাকায় ছাত্ররা ক্লাস বর্জন ও ধর্মঘট পালন এবং সভায় মিলিত হয়ে একুশের আন্দোলন সফল করে তোলে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক