You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে নাটোর - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে নাটোর
বিশেষ ভূমিকা ছাত্রীদের নারীদের

ইতিপূর্বে বলা হয়েছে নওগাঁর থানাগুলােতে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের কথা। কবি জীবনানন্দ দাশ বন্দিত নাটোরও এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে অধ্যাপক তসিকুল ইসলাম ওই অঞ্চলে নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে মহিলারা তৎপর ছিলেন। নাটোরের মহিলারা ভাষা আন্দোলন সমিতি গঠন করেছে এবং প্রতিবাদ সভা করে গুলিবর্ষণকারী দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেছে।’
শুধু নাটোরের নারীরাই নন, এখানকার ছাত্রছাত্রীরাও একুশের আন্দোলনে যথারীতি অংশগ্রহণ করেছেন ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভায় সমবেত হয়ে। রাজধানী ঢাকা থেকে দূর অঞ্চল হওয়া সত্তেও সেখানকার ভাষা আন্দোলনের কিছু সংবাদ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
নাটোরের নারীসমাজের পূর্বোক্ত তৎপরতা সম্পর্কে দৈনিক আজাদ প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন, ‘নাটোর (রাজশাহী), ২৯শে ফেব্রুয়ারী।- ঢাকায় গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে “নাটোর মহিলা ভাষা আন্দোলন সমিতির উদ্যোগে অদ্য এক বিরাট মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতে করিতে সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে। অতঃপর বেগম শামসুন্নাহার সাহেবার সভানেতৃত্বে চৌধুরী সাহেবের মাঠে এক সভা হয়। সভায় গুলীবর্ষণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচার এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি করিয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।’ (আজাদ, ৮ মার্চ ১৯৫২)।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দিঘাপতিয়া স্কুলের ছাত্রদের উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সভা হয়। সভাপতি ছিলেন মৌলভি মােহাম্মদ এসহাক। (অজাদ, ৮ মার্চ ১৯৫২)।
নাটোরে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয় প্রধানত একুশের দাবদাহের প্রভাবে এবং তা অন্যান্য এলাকার মতােই ঢাকায় ছাত্রহত্যার সংবাদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার টানে। নাটোরের ভাষা আন্দোলন স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের অবদান মূলত বয়েজ হাইস্কুল ও গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস বর্জন ও মিছিলে আন্দোলনের সূত্রপাত। নেতৃস্থানীয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য হালিম খান ও শামসুন্নাহারের নাম।
নাটোরের খ্যাতি যেমন কাব্যসূত্রে, তার চেয়ে অনেক বেশি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু জমিদার মহারাজ জগদীন্দ্রনাথের বাংলা ভাষাপ্রেম ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়। তিনি রবীন্দ্রনাথের মতােই শিক্ষাবিস্তারে সেকালে তাঁর এলাকায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্থাপন করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে পূর্বোক্ত দুই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভাষা ধর্মঘট ও মিছিলে যােগ দেয় মহারাজা জে এন হাইস্কুলের ছাত্ররাও। স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। মিছিল শহরের বড় রাস্তাগুলাে পরিক্রমা শেষে স্থানীয় আমতলায় সমবেত হয়। সেখানে ছাত্র-জনতার বিশাল এক সমাবেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বক্তৃতা করা হয়।
স্থানীয় সরকারবিরােধী রাজনৈতিক নেতাদের সস্নেহ প্রশ্রয় ও সমর্থন ছিল ওই ছাত্র আন্দোলনের প্রতি। কারও কারও ছিল সক্রিয় সহযােগিতা। স্মরণযােগ্য যে ১৯ শতকের শেষ দিক থেকেই নাটোরসহ সংলগ্ন অঞ্চলটির খ্যাতি ছিল শিক্ষা ও সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চায়।
পূর্ববঙ্গের তৎকালীন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার অপ্রতুলতার কারণে দূরতম অঞ্চলে সংঘটিত একুশের ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলিও ঢাকার পত্রপত্রিকাগুলােতে সামান্যই উঠে আসে। নাটোরও ব্যতিক্রম নয়। তাই আন্দোলনের বিশদ বিবরণ থেকে লিপিবদ্ধ ইতিহাস বঞ্চিত।
তবু বিচ্ছিন্ন সূত্রে দেখা যায়, নাটোরের ভাষা আন্দোলন এই শহর সংলগ্ন প্রান্তিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আর শহরে ১৯৫৩ এর শহীদ দিবস পালিত হয়েছে। হয়তাে হয়েছে কোনাে প্রান্তিক এলাকার স্কুলেও।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঢাকাসহ একাধিক শহরের ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক রচনায় যেমন তথ্যগত ভুল লক্ষ করা যায়, নাটোরও সে ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। যেমন একটি ছােট বইতে সােহরাওয়ার্দীর নাটোর সফরের কথা বলা হয়েছে। তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। সােহরাওয়ার্দী একুশের আন্দোলনের সময় করাচিতে। বরং বিখ্যাত পশ্চিম পাকিস্তানি সাংবাদিক জেড এ সুলেরি এ সময় ঢাকায় এসেছিলেন অবস্থা দেখে যেতে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক