ভাষা আন্দোলনে কিশােরগঞ্জ
ব্যাপক দমননীতির মুখে একুশে পালন
কিশােরগঞ্জ ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের আমলে অন্যান্য মহকুমার মতাে জেলা হিসেবে চিহ্নিত। ময়মনসিংহ প্রসঙ্গে আমরা উল্লেখ করেছি বৃহৎ এ জেলায় জমিদার ও কৃষকশ্রেণির দ্বন্দ্বের পরিণামে অবিভক্ত বঙ্গের এ অঞ্চলে সম্প্রদায়বাদী মুসলিম লীগ রাজনীতির প্রভাব ছিল অন্য একাধিক অঞ্চলের তুলনায় অধিক শক্তিমান। তবে সব অঞ্চলে পরিস্থিতি এক রকম ছিল না।
কোনাে কোনােটিতে দেখা গেছে কৃষক সমিতির প্রভাবে কৃষকবান্ধব প্রগতিশীল রাজনীতিরও প্রভাব। অবশ্য কিশােরগঞ্জ এদিক থেকে কিছটা ভিন্ন। প্রগতিবাদী কৃষক সম্মেলনগুলাে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একদিকে যেমন যশাের-খুলনায় বা দিনাজপুরে, তেমনি নেত্রকোনা ও জামালপুর মহকুমার নির্দিষ্ট স্থানে। রাজনীতির এ ধারাটি চল্লিশের দশকে বা পাকিস্তান আমলের শুরুতে কিশােরগঞ্জে ছিল ভিন্নতর।
১৯৯৫-এর ফেব্রুয়ারিতে ভােরের কাগজ সাংবাদিক সাইফুল হক মােল্লা কিশােরগঞ্জে ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে স্থানীয় নেতা আশরাফ উদ্দিনের (মাষ্টার) জবানিতে লেখেন, ‘দেশের অন্য এলাকার তুলনায় তখন কিশােরগঞ্জে মুসলিম লীগার এবং মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের দাপট ছিল প্রবল। তবু প্রগতিশীল চেতনায় উদ্বুদ্ধ কিশােরগঞ্জের মানুষজন ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
স্থানীয় মাওলানাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরােধী। এবং উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে তারা প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিতে বা অভিমত প্রকাশ করতে দ্বিধাবােধ করতেন না। যেমন মাওলানা আতাহার আলী, মুসলেহ উদ্দিন প্রমুখ।
এঁদের বিপরীত ধারায় ছিলেন আধুনিক চেতনার আবদুল ওয়াদুল, শামসুদ্দিন আহমদ, হেদায়েত হােসেন এবং বিশিষ্ট ছাত্রনেতা আবু তাহের খান পাঠান। তাঁরা কিশােরগঞ্জে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এঁদের ভূমিকা প্রধানত ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে।
কারণ, একদিকে পূর্বোক্ত মাওলানাবর্গ এবং তাদের মাদ্রাসা ছাত্রকুল, অন্যদিকে স্থানীয় এমএলএসহ (আবু লাইছ) মুসলিম লীগের নেতা-কর্মী ও তাদের মদদপুষ্ট গুন্ডাপান্ডাদের হামলায় ১৯৪৮-এর মার্চের ভাষা আন্দোলন
কিশােরগঞ্জে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। অনেক নেতাকে আত্মগোপনে যেতে বা নিষ্ক্রিয় হতে হয়েছে।
কিন্তু অবস্থার চরিত্র বদল ঘটে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে এসে। তত দিনে কিশােরগঞ্জের রাজনৈতিক চালচিত্রে বেশ কিছু নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। ছাত্রসমাজে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে।
এ পরিস্থিতিতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের ঘােষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কিশােরগঞ্জের ছাত্রনেতা আবু তাহের ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে কিছুটা সঙ্গোপনে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। আহ্বায়ক হেদায়েত হােসেন। সদস্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও ছাত্রনেতারা। সতর্কভাবে চলে একুশের কর্মসূচির পক্ষে প্রচারকাজ।
নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজ এবং একাধিক স্কুলে। অধিকাংশ শহরের দোকানপাট বন্ধ থাকলেও সরকারি কর্মকর্তা ও মুসলিম লীগ নেতাদের জবরদস্তিতে শহরের একাংশে দোকানপাট খােলা রাখতে বাধ্য হয় দোকানিরা (ইন্দিরাপট্টিতে)।
২২ ফেব্রুয়ারি কিশােরগঞ্জে ঢাকার ছাত্র হত্যার খবর প্রচারিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আবু তাহের, হেদায়েত হােসেন প্রমুখ ছাত্রনেতার উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়ােজন করা হলেও প্রভাবশালী নেতাবিশেষের বিরােধিতার মুখে কর্মসূচি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। অবশ্য আবু তাহেরের বক্তৃতায় আশপাশে দাড়ানাে মানুষজন উদ্দীপ্ত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে আন্দোলনের পক্ষে। (সাইফুল হক মােল্লা, ভোরের কাগজ)।
ভিন্নমতে ভাষাসংগ্রামী আশরাফউদ্দিন মাস্টার জানান যে ২২ ফেব্রুয়ারি পত্রিকা মারফত ঢাকায় গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনা জানার পর তাঁরা সবাই বৈঠকে বসে কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। সেদিন সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে বিশাল এক প্রতিবাদ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। তার মতে, শত শত তরুণ এবং ছাত্র-জনতা তাতে অংশ নেয় এবং মিছিলটি সারা শহর প্রদক্ষিণ করে।
পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় খেলার মাঠে দুটো সভা হয়। আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য দেন রশিদুর রহমান চৌধুরী, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, শামসুদ্দিন আহমদ, আমিনুল হক, আবদুস সালাম, আবদুল হামিদ, সুন্দর আলীসহ আশরাফউদ্দিন মাস্টার।
উল্লেখ্য যে এ সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন ছাত্রনেতা আবু তাহের খান পাঠান। এ ধরনের প্রতিটি সভায় কবিতা ও গান উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে উদ্দীপ্ত করেছে প্রতিবাদী চেতনায়, সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণায়। স্বভাবত ক্রুদ্ধ প্রশাসন গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি করে আশরাফ উদ্দিন মাষ্টার, আমিনুল হক, সুন্দর আলী ও আবু তাহেরের বিরুদ্ধে। শেষােক্ত জন গ্রেপ্তার হন, অন্যরা আত্মগােপন করেন। তারা আত্মগােপন অবস্থায় থেকেই নির্দেশ- পরামর্শ দিয়েছেন আন্দোলনকারীদের।
এভাবে আন্দোলন চলেছে মার্চ মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত। আন্দোলন কিশােরগবাসীর ভাষাচেতনাই শাণিত করেছে, লীগ সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।
কিশােরগঞ্জে একুশের ভাষা আন্দোলন এভাবে সরকারি স্বেচ্ছাচারের প্রতিক্রিয়ায় একগুচ্ছ নেতা-কর্মীর জন্ম দিয়েছিল, তৈরি করেছিল ভিন্ন এক কিশােরগঞ্জ। তা সত্ত্বেও এখানকার সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ততটা ঘটাতে পারেনি, তবে রাজনৈতিক চেতনার কিছুটা দিক পরিবর্তন ঘটায়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন তার প্রমাণ। তা সত্ত্বেও সরকারি দাপট ও সামাজিক অবস্থার কারণে সে সময় এখানে কোনাে স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
পূর্বোক্ত নেতাদের চেষ্টায় ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার তৈরির চেষ্টা হয়েছে, আবার রাতের অন্ধকারে তা ভাঙা হয়েছে। শহীদ দিবস পালনও বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আশ্চর্য যে গুরুদয়াল কলেজের ছাত্রদের শহীদ মিনার তৈরি করা নিয়েও নিয়মিত লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে।
যেমন ১৯৬৫ সালে ওই কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি আবদুল হামিদের (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) নেতৃত্বে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে এ দাবি অর্জনের পক্ষে আন্দোলন চালাতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি হয় কিশােরগঞ্জে।
প্রসঙ্গত, কিশােরগঞ্জের ২৩ ফেব্রুয়ারির পূর্বোক্ত জনসভা সম্পর্কে দৈনিক আজাদ-এ ওই দিন প্রকাশিত প্রতিবেদনের কিছু তথ্য, ‘ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে অদ্য এখানে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। অন্যূন ১০ হাজার লােকের সমবায়ে এক জনসভা হয়। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, গুলীবর্ষণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচার, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার এবং বর্তমানে মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ (আজাদ, ১ মার্চ ১৯৫২)।
এ সম্পর্কে দৈনিক আজাদ-এর আরেকটি সংবাদ, ‘২৮শে ফেব্রুয়ারী স্থানীয় খেলার মাঠে অন্যূন ৪০ সহস্র লােকের সমাবেশে এক বিরাট প্রতিবাদ। সভা হয়। সভায় শহর ও গ্রামের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।
মুসলিম লীগ নেতা জনাব আবদুল আজিজ খাঁ সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ, ভাষা আন্দোলনে বন্দীকৃত সকল ছাত্রের মুক্তি এবং বর্তমান মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ (৭ মার্চ ১৯৫২)।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক